পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ԳՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী ওই সকল কবিতার সত্য। সেটাকে ষে আমরা সকল সময়ে কবিতা বিশ্লেষণ করে সমগ্র বের করতে পারি তা নয়, কিন্তু তার শাসন আমরা বেশ অনুভব করতে পারি। গোটিয়ের সহিত ওআর্ডসওআর্থের তুলনা করা যেতে পারে। ওআর্ডসওআর্থের কবিতার মধ্যে যে সৌন্দর্যসত্য প্রকাশিত হয়েছে, তা পূর্বোক্ত ফরাসি সৌন্দর্যসত্য অপেক্ষ বিস্তৃত। তার কাছে পুষ্পপল্লব নদীনিবার পর্বতপ্রাস্তর সর্বত্রই নব নব সৌন্দর্য উদভাসিত হয়ে উঠছে। কেবল তাই নয়, তার মধ্যে তিনি একটা আধ্যাত্মিক বিকাশ দেখতে পাচ্ছেন—তাতে করে সৌন্দর্য অনন্ত বিস্তার এবং অনন্ত গভীরতা লাভ করেছে। তার ফল এই যে, এ-রকম কবিতায় পাঠকের শ্রাস্তি তৃপ্তি বিরক্তি নেই –ওআর্ডসওআর্থের কবিতার মধ্যে সৌন্দর্যের এই বৃহৎ সত্যটুকু থাকাতেই তার এত গৌরব এবং স্থায়িত্ব । বৃহৎ সত্য কেন বলছি, অর্থাৎ বৃহৎই বা কেন বলি, সত্যই বা কেন বলি, তা আর-একটু পরিষ্কার করে বলবার চেষ্টা করি। পরিষ্কার হবে কিনা বলতে পারি না, কিন্তু যতটা বক্তব্য আছে এই স্বযোগে সমস্তটা বলে রাখা ভাল । একটি পুষ্পের মধ্যে আমাদের হৃদয়ের প্রবেশ করবার একটিমাত্র পথ আছে— তার বাহ সৌন্দর্য। ফুল চিস্তা করে না, ভালোবাসে না, ফুলের মুখদুঃখ নেই, সে কেবল স্বন্দর আকৃতি নিয়ে ফোটে। এইজন্ত সাধারণত ফুলের সঙ্গে মানুষের আর কোনো সম্পর্ক নেই, কেবল আমরা ইঞ্জিয়যোগে তার সৌন্দৰ্যটুকু উপলব্ধি করতে পারি মাত্র । এইজন্য সচরাচর ফুলের মধ্যে আমাদের সমগ্র মনুষ্যত্বের পরিতৃপ্তি নেই— তাতে কেবল আমাদের আংশিক আনন্দ ; কিন্তু কবি যখন এই ফুলকে কেবলমাত্র জড় সৌন্দর্য ভাবে না দেখে এর মধ্যে মানুষের মনোভাব আরোপ করে দেখিয়েছেন তখন তিনি আমাদের আনন্দকে আরও বৃহত্তর গাঢ়তর করে দিয়েছেন। এ-কথা একটা চিরসত্য যে, যাদের কল্পনাশক্তি আছে তারা সৌন্দর্যকে নিজীব ভাবে দেখতে পারে না। তারা অনুভব করে যে, সৌন্দর্ধ যদিও বস্তুকে অবলম্বন করে প্রকাশ পায় কিন্তু তা যেন বস্তুর অতীত, তার মধ্যে যেন একটা মনের ধর্ম আছে। এইজন্ত মনে হয় সৌন্দর্ষে যেন একটা ইচ্ছাশক্তি, একটা আনন্দ, একটা আত্মা আছে। ফুলের আত্মা যেন সৌন্দর্ষে বিকশিত প্রফুল্ল হয়ে ওঠে, জগতের আত্মা যেন অপার বহিঃসৌন্দর্বে আপনাকে প্রকাশ করে । অস্তরের অসীমতা যেখানে বাহিরে আপনাকে প্রকাশ করতে পেরেছে সেইখানেই যেন সৌন্দর্ব —সেই প্রকাশ যেখানে যত অসম্পূর্ণ সেইখানে তত সৌন্দর্ষের অভাব, রূঢ়তা, জড়তা, চেষ্টা, দ্বিধা ও সর্বাঙ্গীণ অসামঞ্জস্ত ।