পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী سنانهاج উপক্রম করিলেন। তাহ দেখিয়া বিন্ধ্যবাসিনী নিরতিশয় লজ্জিত হইল। তাহার মনে যে একটি সহজ আত্মসন্ত্ৰমবোধ ছিল তাহা হইতেই সে বুঝিল, এরূপস্থলে সর্বসমক্ষে অভিমান প্রকাশ করার মতো লজ্জাকর আত্মাবমাননা আর কিছুই নাই। হাতে পায়ে ধরিয়া কাদিয়া কাটিয়া বহু কষ্টে সে তাহার স্বামীকে ক্ষাস্ত করিয়া রাখিল । বিন্ধ্য অবিবেচক ছিল না, এইজন্য সে তাহার পিতামাতার প্রতি কোনো দোষারোপ করিল না ; সে বুঝিল, ঘটনাটি সামান্ত ও স্বাভাবিক। কিন্তু, এ কথাও তাহার মনে হইল যে,তাহার স্বামী শ্বশুরালয়ে বাস করিয়া কুটুম্বের আদর হইতে বঞ্চিত হইতেছেন। সেই দিন হইতে প্রতিদিন সে তাহার স্বামীকে বলিতে লাগিল,”আমাকে তোমাদের ঘরে লইয়া চলো ; আমি আর এখানে থাকিব না।” t অনাথবন্ধুর মনে অহংকার যথেষ্ট ছিল কিন্তু আত্মসন্ত্ৰমবোধ ছিল না। র্তাহার নিজ গৃহের দারিদ্র্যের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করিতে কিছুতেই তাহার অভিরুচি হইল না । তখন তাহার স্ত্রী কিছু দৃঢ়তা প্রকাশ করিয়া কহিল, “তুমি যদি না যাও তো আমি একলাই যাইব ।” অনাথবন্ধু মনে মনে বিরক্ত হইয় তাহার স্ত্রীকে কলিকাতার বাহিরে দূর ক্ষুদ্র পল্লীতে র্তাহাদের মৃত্তিকানিৰ্মিত খোড়ো ঘরে লইয়া যাইবার উদযোগ করিলেন। যাত্রাকালে রাজকুমার বাবু এবং তাহার স্ত্রী কন্যাকে আরো কিছুকাল পিতৃগৃহে থাকিয়া যাইবার জন্য অনেক অনুরোধ করিলেন ; কন্যা নীরবে নতশিরে গম্ভীরমুখে বসিয়া মৌনভাবে জানাইয়া দিল, না, সে হইতে পারিবে না । তাহার সহসা এরূপ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দেখিয়া পিতামাতার সন্দেহ হইল যে, অজ্ঞাতসারে বোধ করি কোনোরূপে তাহাকে আঘাত দেওয়া হইয়াছে। রাজকুমার বাবু ব্যথিতচিত্তে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, আমাদের কোনো অজ্ঞানকৃত আচরণে তোমার মনে কি ব্যথা লাগিয়াছে।” বিন্ধ্যবাসিনী তাহার পিতার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া কহিল,“এক মুহূর্তের জন্তও নহে। তোমাদের এখানে বড়ো মুখে বড়ো অাদরে আমার দিন গিয়াছে।” বলিয়া সে কাদিতে লাগিল। কিন্তু তাহার সংকল্প অটল রহিল। বাপ মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিলেন,যত স্নেহে যত আদরেই মানুষ কর, বিবাহ দিলেই মেয়ে পর হইয়া যায়। অবশেষে আশ্রনেত্ৰে সকলের নিকট বিদায় লইয়া আপন আজন্মকালের স্নেহমণ্ডিত পিতৃগৃহ এবং পরিজন ও সঙ্গিনীগণকে ছাড়িয়া বিন্ধ্যবাসিনী পালকিতে আরোহণ করিল।