পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२१२ রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকিত ; জল ছল ছল করিত, নৌকা ভাসিয়া যাইত, শাখার উপরে চঞ্চল অন্তমনস্ক পাখি কিচমিচ শকে স্বগত উক্তি প্রকাশ করিত, নীলকান্ত বইয়ের পাতায় চক্ষু রাখিয়া কী ভাবিত সেই জানে অথবা সেও জানে না। একটা কথা হইতে কিছুতেই আরএকটা কথায় গিয়া পৌছিতে পারিত না, অথচ বই পড়িতেছি মনে করিয়া তাহার ভারি একটা আত্মগৌরব উপস্থিত হইত। সামনে দিয়া যখন একটা নৌকা যাইত তখন সে আরো অধিক আড়ম্বরের সহিত বইখানা তুলিয়া বিড়, বিড়, করিয়া পড়ার ভান করিত ; দশক চলিয়া গেলে সে আর পড়ার উৎসাহ রক্ষা করিতে পারিত না । পূর্বে সে অভ্যস্ত গানগুলো যন্ত্রের মতো যথানিয়মে গাহিয়া যাইত, এখন সেই গানের স্বরগুলো তাহার মনে এক অপূর্ব চাঞ্চল্য সঞ্চার করে। গানের কথা অতি যৎসামান্ত, তুচ্ছ অনুপ্রাসে পরিপূর্ণ, তাহার অর্থও নীলকাস্তের নিকট সম্যক বোধগম্য নহে, কিন্তু যখন সে গাহিত— ওরে রাজহংস, জন্মি দ্বিজবংশে এমন নৃশংস কেন হলি রে— বল কী জন্তে, এ অরণ্যে, রাজকন্যের প্রাণসংশয় করিলি রে— তখন সে যেন সহসা লোকান্তরে জন্মান্তরে উপনীত হইত ; তখন চারি দিকের অভ্যস্ত জগংটা এবং তাহার তুচ্ছ জীবনটা গানে তর্জমা হইয়া একটা নূতন চেহারা ধারণ করিত। রাজহংস এবং রাজকন্যার কথা হইতে তাহার মনে এক অপরূপ ছবির আভাস জাগিয়া উঠিত, সে আপনাকে কী মনে করিত স্পষ্ট করিয়া বলা যায় না, কিন্তু যাত্রার দলের পিতৃ-মাতৃহীন ছোকরা বলিয়া ভুলিয়া যাইত। নিতান্ত অকিঞ্চনের ঘরের হতভাগ্য মলিন শিশু যখন সন্ধ্যাশয্যায় শুইয়া রাজপুত্র রাজকন্যা এবং সাত রাজার ধন মানিকের কথা শোনে, তখন সেই ক্ষীণদীপালোকিত জীর্ণ গৃহকোণের অন্ধকারে তাহার মনটা সমস্ত দারিদ্র্য ও হীনতার বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া এক সর্বসম্ভব রূপকথার রাজ্যে একটা নূতন রূপ, উজ্জল বেশ এবং অপ্রতিহত ক্ষমতা ধারণ করে ; সেইরূপ গানের স্বরের মধ্যে এই যাত্রার দলের ছেলেটি আপনাকে এবং আপনার জগৎটকে একটি নবীন আকারে স্বজন করিয়া তুলিত— জলের ধ্বনি, পাতার শব্দ, পাখির ভাক । এবং ষে লক্ষ্মী এই লক্ষ্মীছাড়াকে আশ্রয় দিয়াছেন তাহার সহান্ত স্নেহমুখচ্ছবি, তাহার কল্যাণমণ্ডিত বলয়বেষ্টিত বাহু দুইখানি এবং দুর্লভ স্বন্দর পুষ্পদলকোমল রক্তিম চরণযুগল কী এক মায়ামন্ত্রবলে রাগিণীর মধ্যে রূপান্তরিত হইয়া যাইত। আবার একসময় এই গীতিমরীচিকা কোথায় অপসারিত হইত, যাত্রার দলের নীলকান্ত বাঁকড়া