পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ঊনবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ybr রবীন্দ্র-রচনাবলী পোঁচেছিল, কত মিলনে, কত বিরহে, কত কান্নায়, কত হাসিতে ; শরতের ভোরবেলায়, বসন্তের সায়াহ্নে, বর্ষার নিশীথরাত্রে ; কত ধ্যানের শাস্তিতে, পূজার আত্মনিবেদনে, দুঃখের গভীরতায় ; কত দানে, কত গ্রহণে, কত ত্যাগে, কত সেবায়— তারা আমার দিনের পথে সুর হয়ে বেজেছিল, আজ তারাই আমার রাত্রের পথে দীপ হয়ে জলে উঠছে। সেই অন্ধকারের ঝরনা থেকেই আমার জীবনের অভিষেক, সেই অন্ধকারের নিস্তব্ধতার মধ্যে আমার মৃত্যুর আমন্ত্রণ ; আজ আমি তাকে বলতে পারব, হে চিরপ্রচ্ছন্ন, আমার মধ্যে যা-কিছু তুমি তোমার গভীরের ভিতর থেকে তারার মতো প্রকাশ করেছ রূপে ও বাণীতে, তাতেই নিত্যকালের অমৃত ; আমি খুজে খুজে পাথর কুড়িয়ে কুড়িয়ে কীতির যে-জয়স্তম্ভ গেথেছি, কালস্রোতের ভাঙনের উপরে তার ভিত। সেইজন্যেই আজ গোধূলির ধূসর আলোয় একলা বসে ভাবছিলুম, রঙিন রসের অক্ষরে লেখা যে-লিপি তোমার কাছ থেকে ক্ষণে ক্ষণে এসেছিল ভালো করে তা পড়া হয় নি, ব্যস্ত ছিলুম। তার মধ্যে নিমন্ত্রণ ছিল। কোথায় । কারখানাঘরে নয়, খাতাঞ্চিখানায় নয়, ছোটো ছোটো কোণে যেখানে ধরণীর ছোটো স্বথগুলি লুকানো । তাই আজ পিছন ফিরে তাকিয়ে মনে মনে ভেবে দেখছি, কতবার বঞ্চিত হলুম। জনতার জয়ধ্বনির ডাকে কতবার অন্যমনে গভীর নিভৃতের পাশ দিয়ে চলে এসেছি ; মায়ামৃগের অনুসরণে কতবার সরল স্বন্দরের দিকে চোখ পড়ল না। জীবনপথে আশে পাশে সুধার-কণা-ভরা যে বিনামূল্যের ফলগুলি পাতার আড়ালে ঢাকা ছিল, তাদের এড়িয়ে উপবাসী হয়ে চলে এসেছি বলেই এত প্রাস্তি, এত অবসাদ । প্রভাত যেখান থেকে আপন পেয়ালা আলোতে ভরে নেয়, রাত্রি যার আঙিনায় বসে প্রাণের ছিন্ন সূত্রগুলি বারে বারে জুড়ে তোলে, ওই লুকিয়ে-থাকা ছোটো ফলগুলি সেই মহান্ধকারেরই রহস্তগর্ভ থেকে রস পেয়ে ফলে উঠছে, সেই অন্ধকার— যন্ত ছায়ামৃতং যন্ত মৃত্যুঃ । ক্রাকোভিয়া জাহাজ ১৩ই ফেব্রুয়ারি ৯২৫ বাংলা ভাষায় প্রেম অর্থে দুটো শব্দের চল আছে ; ভালোলাগা আর ভালোবাসা। এই দুটো শব্দে আছে প্রেমসমুদ্রের দুই উলটোপারের ঠিকানা । যেখানে ভালোলাগা সেখানে ভালো আমাকে লাগে, যেখানে ভালোবাসা সেখানে ভালো অন্তকে বাসি । আবেগের মুখটা যখন নিজের দিকে তখন ভালোলাগা, যখন অন্তের দিকে তখন ভালোবাসা । ভালোলাগায় ভোগের তৃপ্তি, ভালোবাসায় ত্যাগের সাধন । সংস্কৃত ভাষায় অনুভব বলতে যা বুঝি তার খাটি বাংলা প্রতিশব্দ একদিন ছিল।