পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७br२ রবীন্দ্র-রচনাবলী ইংরাজিতে অনেক সময় আট-দশ লাইনের একটি ছোটো কবিতা লঘুৰাণের মতো ক্ষিপ্রগতিতে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া মর্মের মধ্যে বিদ্ধ হইয়া থাকে। বাংলায় ছোটে কবিতা আমাদের হৃদয়ের স্বাভাবিক জড়তায় আঘাত দিতে পারে না । বোধ করি কতকটা সেই কারণে আমাদের ভাষার এই খর্বত আমরা অত্যুক্তি দ্বারা পূরণ করিয়া লইতে চেষ্টা করি । একটা কথা বাহুল্য করিয়া না বলিলে আমাদের ভাষায় বড়োই ফণকণ শুনায় এবং সে কথা কাহারো কানে পৌছায় না । সেইজন্ত সংক্ষিপ্ত সংহত রচনা আমাদের দেশে প্রচলিত নাই বলিলেই হয় । কোনো লেখা অত্যুক্তি পুনরুক্তি বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং আড়ম্বর -পূর্ণ না হইলে সাধারণত গ্রাহ হয় না। বাংলা পড়িবার সময় অনেক পাঠক অধিকাংশ স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করিয়া টানিয়া টানিয়া পড়েন। নচেৎ সমমাত্র হ্রস্বস্বরে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ কুলাইয়া উঠে না। বাংলার বক্তারা অনেকেই দীর্ঘ উচ্চারণ প্রয়োগ করিয়া বক্তৃতা বৃহৎ ও গভীর করিয়া তোলেন । ভালো ইংরাজ অভিনেতার অভিনয়ে দেখিতে পাওয়া যায়, এক-একটি শব্দকে সবলৈ বেষ্টন করিয়া প্রচণ্ড হৃদয়াবেগ কিরূপ উদামগতিতে উচ্ছ্বলিত হইয়া উঠে। কিন্তু, বাংলা অভিনয়ে শিথিল কোমল কথাগুলি হৃদয়স্রোতের নিকট সহজেই মাথা নত করিয়া দেয়, তাহাকে ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না । এইজন্য তাহাতে সর্বত্রই একপ্রকার দুর্বল সময়ত সামুনাসিক ক্ৰন্দনস্বর ধ্বনিত হইতে থাকে। এইজস্ত আমাদের অভিনেতারা যেখানে শ্রোতাদের হৃদয় বিচলিত করিতে চান সেখানে গলা চড়াইয়া অযথা-পরিমাণে চিৎকার করিতে থাকেন এবং তাহাতে প্রায়ই ফললাভ করেন । মাইকেল তাহার মহাকাব্যে যে বড়ো বড়ো সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন— শব্দের স্থায়িত্ব, গাম্ভীর্ষ এবং পাঠকের সমগ্র মনোযোগ বদ্ধ করিবার চেষ্টাই তাহার কারণ বোধ হয় । ‘যাদুপতিরোধঃ যথা চলোমি-আঘাতে দুর্বোধ হইতে পারে, কিন্তু ‘লাগরের তট যথা তরঙ্গের ঘায়' দুর্বল , উড়িল কলম্বকুল অম্বরপ্রদেশে' ইহার পরিবর্তে উড়িল যতেক তীর আকাশ ছাইয়া ব্যবহার করিলে ছন্দের পরিপূর্ণ ধ্বনি নষ্ট হয়। বাংলা শব্দের মধ্যে এই ধ্বনির অভাববশত বাংলায় পষ্ঠের অপেক্ষা গীতের প্রচলনই অধিক। কারণ, গীত স্বরের সাহায্যে প্রত্যেক কথাটিকে মনের মধ্যে সম্পূর্ণ নিৰিষ্ট করিয়া দেয় । কথায় যে অভাব আছে স্বরে তাহা পূর্ণ হয়। এবং গানে এক কথা বারবার ফিরিয়া গাহিলে ক্ষতি হয় না। যতক্ষণ চিত্ত না জাগিয়া উঠে ততক্ষণ সংগীত ছাড়ে না । এইজন্ত প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে গান ছাড়া কবিতা নাই বলিলে হয় । সংস্কৃতে ইহার বিপরীত দেখা যায়। বেদ ছাড়িয়া দিলে সংস্কৃত ভাষায় এত মহাকাব্য খণ্ডকাব্য সত্বেও গান নাই। শকুন্তলা প্রভৃতি নাটকে ষে দুই-একটি প্রাক্কত