পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Obt রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তাহাতে চারুর সুকোমল হৃদয়ালুতার পরিচয় পাইয়া ভূপতি মনে মনে খুশি হইত। আজ আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিল, সে সমস্তই কি ভাসা-ভাসা, হৃদয়ের মধ্যে তাহার কোনো ভিত্তি ছিল না ? ভূপতি ভাবিল, চারুর হৃদয় যদি না থাকে। তবে কোথায় ভূপতি আশ্রয় পাইবে । অল্পে অল্পে পরীক্ষা করিবার জন্য ভূপতি কথা পাডিল, “চারু, তুমি ভালো ছিলে তো ? তোমার শরীর খারাপ নেই ?” চারু সংক্ষেপে উত্তর করিল, “ভালোই আছি ।” ভূপতি । অমলের তো বিয়ে চুকে গেল । এই বলিয়া ভূপতি চুপ করিল ; চারু তৎকালোচিত একটা কোনো সংগত কথা বলিতে অনেক চেষ্টা করিল, কোনো কথাই বাহির হইল না ; সে আড়ষ্ট হইয়া রহিল । ভূপতি স্বভাবতই কখনো কিছু লক্ষ্য করিয়া দেখে না— কিন্তু অমলের বিদায়শোক তাহার নিজের মনে লাগিয়া আছে বলিয়াই চারুর ঔদাসীন্য তাহাকে আঘাত করিল । তাহার ইচ্ছা ছিল, সমবেদনায় ব্যথিত চারুর সঙ্গে আমলের কথা আলোচনা করিয়া সে হৃদয়ভার লাঘব করিবে । ভূপতি । মেয়েটিকে দেখতে বেশ - চারু, ঘুমোচ্ছ ? চারু কহিল, “না ।” ভূপতি । বেচারা অমল একলা চলে গেল। যখন তাকে গাডিতে উঠিয়ে দিলুম, সে ছেলেমানুষের মতো কান্দতে লাগিল- দেখে এই বুডোবয়সে আমি আর চোখের জল রাখতে পারলাম না । গাড়িতে দুজন সাহেব ছিল, পুরুষমানুষের কাল্লা দেখে তাদের ভারি আমোদ বোধ হল : নির্বাণদীপ শয়নঘরে বিছানার অন্ধকারের মধ্যে চারু প্ৰথমে পাশ ফিবিয়া শুইল, তাহার পর হঠাৎ তাড়াতাড়ি বিছানা ছাডিয়া চলিয়া গেল। ভূপতি চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চারু, অসুখ করেছে ?” কোনো উত্তর না পাইয়া সেও উঠিল । পাশে বারান্দা হইতে চাপা কাল্লার শব্দ শুনিতে পাইয়া ক্ৰন্তপদে গিয়া দেখিল, চারু মাটিতে পডিয়া উপূড হইয়া কান্না রোধ করিবার চেষ্টা করিতেছে । এরূপ দুরন্ত শোকোঙ্গ্যুস দেখিয়া ভূপতি আশ্চর্য হইয়া গেল। ভাবিলে, চারুকে কী ভুল বুঝিয়েছিলাম । চারুর স্বভাব এতই চাপা যে, আমার কাছেও হৃদয়ের কোনো বেদনা প্ৰকাশ করিতে চাহে না । যাহাদের প্রকৃতি এইরূপ তাহদের ভালোবাসা সুগভীর এবং তাহদের বেদনাও অত্যন্ত বেশি। চারুর প্রেম সাধারণ স্ত্রীলোকদের ন্যায় বাহির হইতে তেমন পরিদৃশ্যমান নহে, ভূপতি তাহা মনে মনে ঠাহর করিয়া দেখিল । ভূপতি চারুর ভালোবাসার উচ্ছাস কখনো দেখে নাই ; আজ বিশেষ করিয়া বুঝিল, তাহার কারণ অন্তরের দিকেই চারুর ভালোবাসার গোপন প্রসার । ভূপতি নিজেও বাহিরে প্রকাশ করিতে অপটু ; চারুর প্রকৃতিতেও হৃদয়াবেগের সুগভীর অন্তঃশীলতার পরিচয় পাইয়া সে একটা তৃপ্তি অনুভব করিল। ভূপতি তখন চারুর পাশে বসিয়া কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। কী করিয়া সাত্মনা করিতে হয়। ভূপতির তাহা জানা ছিল না- ইহা সে বুঝিল না, শোককে যখন কেহ অন্ধকারে কণ্ঠ চাপিয়া হত্যা করিতে চাহে তখন সাক্ষ্মী বসিয়া থাকিলে ভালো क्tश न । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ ভূপতি যখন তাহার খবরের কাগজ হইতে অবসর লইল তখন নিজের ভবিষ্যতের একটা ছবি নিজের মনের মধ্যে আঁকিয়া লইয়াছিল। প্রতিজা করিয়াছিল, কোনো প্রকার দুরাশা-দুশ্চেষ্টায় যাইবে না, চারুকে লইয়া পড়াশুনা ভালোবাসা এবং প্রতিদিনের ছোটোখাটো গাৰ্হস্থ্য কর্তব্য পালন করিয়া