পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 So রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ভূপতি ক্ষুব্ধ হইয়া ভাবিল, “আমি বড়ো নীরস লোক, চারুকে কিছুতেই আমি সুখী করিতে পারিতেছি না ।” এই ভাবিয়া সে সাহিত্য লইয়া পড়িল । বন্ধুরা কখনো বাড়ি আসিলে বিস্মিত হইয়া দেখিত, ভূপতি টেনিসন, বাইরুন, বঙ্কিমের গল্প এই সমস্ত লইয়া আছে। ভূপতির এই অকাল-কাব্যানুরাগ দেখিয়া বন্ধুবান্ধবেরা অত্যন্ত ঠাট্টাবিদ্যুপ করিতে লাগিল। ভূপতি হাসিয়া কহিল, “ভাই, ধাশের ফুলও ধরে, কিন্তু কখন ধরে তার ঠিক নেই।” একদিন সন্ধাবেলায় শোবার ঘরে বড়ো বাতি জ্বালাইয়া ভূপতি প্ৰথমে লজ্জায় একটু ইতস্তত করিল ; পরে কহিল, “একটা কিছু পড়ে শোনাব ?” চারু কহিল, “শোনাও-না ।” ভূপতি । কী শোনাব। bS | (OfA: T SUL | ভূপতি চারুর অধিক আগ্রহ না দেখিয়া একটু দমিল। তবু সাহস করিয়া কহিল, “টেনিসন থেকে একটা কিছু তর্জমা করে তোমাকে শোনাই ।” চারু কহিল, “শোনাও ।” সমস্তই মাটি হইল। সংকোচ ও নিরুৎসাহে ভূপতির পড়া বাধিয়া যাইতে লাগিল, ঠিকমত বাংলা প্রতিশব্দ জোগাইল না। চারুর শূন্যদৃষ্টি দেখিয়া বোঝা গেল, সে মন দিতেছে না। সেই দীপালোকিত ছোটাে ঘরটি, সেই সন্ধ্যাবেলাকার নিভৃত অবকাশটুকু তেমন করিয়া ভরিয়া উঠিল না। ভূপতি আরো দুই-একবার এই ভ্ৰম করিয়া অবশেষে স্ত্রীর সহিত সাহিত্য-চৰ্চার চেষ্টা পরিত্যাগ कछिन । 彰 পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ যেমন গুরুতর আঘাতে স্নায়ু অবশ্য হইয়া যায় এবং প্রথমটা বেদনা টের পাওয়া যায় না, সেইরূপ বিচ্ছেদের আরম্ভকালে আমলের অভাব চারু ভালো করিয়া যেন উপলব্ধি করিতে পারে নাই । অবশেষে যতই দিন যাইতে লাগিল ততই অমলের অভাবে সাংসারিক শূন্যতার পরিমাপ ক্রমাগতই যেন বাড়িতে লাগিল। এই ভীষণ আবিষ্কারে চারু হতবুদ্ধি হইয়া গেছে। নিকুঞ্জবন হইতে বাহির হইয়া সে হঠাৎ এ কোন মরুভূমির মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে— দিনের পর দিন যাইতেছে, মরুপ্রান্তর ক্রমাগতই বাড়িয়া চলিয়াছে। এ মরুভূমির কথা সে কিছুই জানিত না । ঘুম থেকে উঠিয়াই হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক করিয়া উঠে- মনে পড়ে, অমল নাই। সকালে যখন সে বারান্দায় পান সাজিতে বসে, ক্ষণে ক্ষণে কেবলই মনে হয়, অমল পশ্চাৎ হইতে আসিবে না । এক-একসময় অন্যমনস্ক হইয়া বেশি পান সাজিয়া ফেলে, সহসা মনে পড়ে, বেশি পান খাইবার লোক নাই । যখনই ভাড়ার ঘরে পদাৰ্পণ করে মনে উদয় হয়, অমলের জন্য জলখাবার দিতে হইবে না । মনের অধৈৰ্য অন্তঃপুরের সীমান্তে আসিয়া তাহাকে স্মরণ করাইয়া দেয়, অমল কলেজ হইতে আসিবে না। কোনো একটা নূতন বই, নূতন লেখা, নূতন খবর, নূতন কৌতুক প্রত্যাশা করিবার নাই ; কাহারও জন্য কোনো সেলাই করবার, কোনো লেখা লিখিাবার, কোনো শৌখিন জিনিস কিনিয়া রাখিবার নাই । নিজের অসহ্য কষ্টে ও চাঞ্চল্যে চারু নিজে বিস্মিত । মনোবেদনার অবিশ্রাম পীড়নে তাহার ভয় হইল । নিজে কেবলই প্রশ্ন করিতে লাগিল, কেন । এত কষ্ট কেন হইতেছে। অমল আমার এতই কী যে, তাহার জন্য এত দুঃখ ভোগ করিব। আমার কী হইল, এতদিন পরে আমার এ কী হইল। দাসী চাকর রান্তার মুটেমজুরগুলাও নিশ্চন্ত হইয়া ফিরিতেছে, আমার এমন হইল কেন । ভগবান হরি, আমাকে এমন বিপদে কোন ফেলিলে ।” কেবলই প্রশ্ন করে এবং আশ্চর্য হয়, কিন্তু দুঃখের কোনো উপশম হয় না। অমলের স্মৃতিতে তাহার অন্তর-বহির এমনি পরিব্যাপ্ত যে, কোথাও সে পালাইবার স্থান পায় না ।