পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 8ከr(ሉ মুদির দোকানে আশ্রয় লইয়াছিল। সেই মুদি এতক্ষণ রাত্রে প্রদীপ নিবাইয়া দোকানে কঁপি বন্ধ করিয়া ধীরে ধীরে গ্রামে বাড়িমুখে আহার করিতে চলিয়াছে, এই কথা স্মরণ করিয়া তাহার মনে হইতে লাগিল, মুদি কী সুখেই আছে। আজ কী বার কে জানে। যদি রবিবার হয় তবে এতক্ষণে হাটের লোক যে যার আপন আপনি বাড়ি ফিরিতেছে, সঙ্গচ্যুত সাথিকে উর্ধস্বরে ডাক পাড়িতেছে, দল বাধিয়া খেয়ানীেকায় পার হইতেছে ; মেঠো রান্তা ধরিয়া, শস্যক্ষেত্রের আল বাহিয়া, পীর শুষ্ক বংশপত্ৰখচিত অঙ্গনপার্শ্ব দিয়া চাষী লোক হাতে দুটাে-একটা মাছ কুলইয়া মাথায় একটা চুপড়ি লইয়া অন্ধকারের আকাশভরা তারার ক্ষীণালোকে গ্রামে গ্রামান্তরে চলিয়াছে । ধরণীর উপরিতলে এই বিচিত্র বৃহৎ চিরাচঞ্চল জীবনযাত্রার মধ্যে তুচ্ছতম দীনতম হইয়া নিজের জীবন মিশাইবার জন্য শতস্তর মৃত্তিকা ভেদ করিয়া তাহার কাছে লোকালয়ের আহবান আসিয়া পৌছিতে লাগিল । সেই জীবন, সেই আকাশ, সেই আলোক, পৃথিবীর সমস্ত মণিমাণিক্যের চেয়ে তাহার কাছে দুর্মুল্য বোধ হইতে লাগিল । তাহার মনে হইতে লাগিল, কেবল ক্ষণকালের জন্য একবার যদি আমার সেই শ্যামাজননী ধরিত্রীর ধূলিক্ৰোড়ে, সেই উন্মুক্ত আলোকিত নীলাম্বরের তলে, সেই তৃণাপত্রের গন্ধবাসিত বাতাস বুক ভরিয়া একটিমাত্র শেষ নিশ্বাসে গ্রহণ করিয়া মরিতে পারি। তাহা হইলেও জীবন সার্থক হয় । এমন সময় দ্বার খুলিয়া গেল । সন্ন্যাসী ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “মৃত্যুঞ্জয়, কী চাও।” সে বলিয়া উঠিল, “আমি আর কিছুই চাই না— আমি এই সুরঙ্গ হইতে, অন্ধকার হইতে, গোলকধাঁধা হইতে, এই সোনার গারদ হইতে, বাহির হইতে চাই । আমি আলোক চাই, আকাশ চাই, মুক্তি চাই ।” সন্ন্যাস। কহিলেন, “এই সোনার ভাণ্ডারের চেয়ে মূল্যবান রত্নভাণ্ডার এখানে আছে। একবার যাইবে नों ?” মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “না, যাইব না ।” সন্ন্যাসী কহিলেন, “একবার দেখিয়া আসিবার কৌতুহলও নাই ?” মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “না, আমি দেখিতেও চাই না। আমাকে যদি কীেপীন পরিয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতে হয় তবু আমি এখানে এক মূহুৰ্তও কাটাইতে ইচ্ছা করি না ।” সন্ন্যাসী কহিলেন, “আচ্ছা, তবে এসো ।” মৃত্যুঞ্জয়ের হাত ধরিয়া সন্ন্যাসী তাহাকে সেই গভীর কৃপের সম্মুখে লইয়া গেলেন । তাহার হাতে সেই লিখনপত্ৰ দিয়া কহিলেন, “এখানি লইয়া তুমি কী করিবে ।” মৃত্যুঞ্জয় সে পত্ৰখানি টুকরা টুকরা করিয়া ছিড়িয়া কৃপের মধ্যে নিক্ষেপ করিল। কাঙিক ১৩১৪ রাসমণির ছেলে S কালীপদার মা ছিলেন রাসমণি- কিন্তু তাহাকে দায়ে পডিয়া বাপের পদ গ্রহণ করিতে হইয়াছিল, কারণ, বাপ মা উভয়েই মা হইয়া উঠিলে ছেলের পক্ষে সুবিধা হয় না । তাহার স্বামী ভবানীচরণ ছেলেকে একেবারেই শাসন করিতে পারেন না । তিনি কেন এত বেশি আদর দেন তাহা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি যে উত্তর দিয়া থাকেন তাহা বুঝিতে হইলে পূর্ব ইতিহাস জানা চাই ।