পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Net NR br রবীন্দ্র-রচনাবলী এখানে পরধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি কিরকম ব্যবহার এই প্রশ্নের উত্তরে শুনলুম, পূর্বকালে জরথুষ্ট্ৰীয় ও বাহাইদের প্রতি অত্যাচার ও অবমাননা ছিল । বর্তমান রাজার শাসনে পরধর্মমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দূর হয়ে গেছে ; সকলেই ভোগ করছে সমান অধিকার, ধর্মহিংস্রতার নররক্তপঙ্কিল বিভীষিকা কোথাও নেই। ডাক্তার মহম্মদ ইসা খা সাদিকের রচিত আধুনিক পারস্যের শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধীয় গ্রন্থে লিখিত আছে- অনতিকাল পূর্বে ধর্মযাজকমণ্ডলীর প্রভাব পারস্যকে অভিভূত করে রেখেছিল। আধুনিক বিদ্যাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রভাবের প্রবলতা কমে এল। এর পূর্বে নানা শ্রেণীর অসংখ্য লোক, কেউ-বা ধর্মবিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউ-বা। ধর্মপ্রচারক, কোরানপাঠক, সৈয়দ- এরা সকলেই মোল্লাদের মতো পাগড়ি ও সাজসজ্জা ধারণ করত । যখন দেশের প্রধানবগের অধিকাংশ লোক আধুনিক প্ৰণালীতে শিক্ষিত হলেন তখন থেকে বিষয়বুদ্ধিপ্রবীণ পুরোহিতদের ব্যবসায় সংকুচিত হয়ে এল । এখন যে খুশি মোল্লার বেশ ধরতে পারে না । বিশেষ পরীক্ষা পাস করে অথবা প্রকৃত ধাৰ্মিক ও ধর্মশাস্ত্ৰবিং পণ্ডিতের সম্মতি -অনুসারে তবেই এই সাজ-ধারণের অধিকার পাওয়া যায়। এই আইনের তাড়নায় শতকরা নকবই সংখ্যক মানুষের মোল্লার বেশ ঘুচে গেছে । লেখক বলেন : Such were the results of the contact of Persia with the Western world They could not have been attained without the leadership of Reza Shah Pehlevi, the greatest man that Persia has produced for many centuries. অন্তত একবার কল্পনা করে দেখতে দোষ নেই যে, হিন্দুভারতে যত অসংখ্য পাণ্ডা পুরোহিত ও সন্ন্যাসী আছে কোনো নূতন আইনে তাদের উপাধি-পরীক্ষা পাস আবশ্যিক বলে গণ্য হয়েছে । কে যথার্থ সাধু বা সন্ন্যাসী কোনো পরীক্ষার দ্বারা তার প্রমাণ হয় না। স্বীকার করি।- কিন্তু স্বেচ্ছাগহীত উপাধি ও বাহ্য বেশের দ্বারা তার প্রমাণ আরো অসম্ভব । অথচ সেই নিরর্থক প্রমাণ দেশ স্বীকার করে নিয়েছে। কেবলমাত্র অপরীক্ষিত সাজের ও অনায়াসলব্ধ নামের প্রভাবে ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ লোকের মাথা নত হচ্ছে বিনা বিচারে এবং উপবাসপীড়িত দেশের অন্নমুষ্টি অনায়াসে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, যার পরিবর্তে অধিকাংশ স্থলে আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কোনো প্রতিদান নেই। সাধুতা ও সন্ন্যাস যদি নিজের আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য হয় তা হলে সাজ পরিবার বা নাম নেবার দরকার নেই, এমন-কি, নিলে ক্ষতির কারণ আছে ; যদি অন্যের জন্য হয় তা হলে যথোচিত পরীক্ষা দেওয়া উচিত । ধর্মকে যদি জীবিকা, এমন-কি, লোকমান্যতার বিষয় করা যায়, যদি বিশেষ বেশ বা বিশেষ ব্যবহারের দ্বারা ধাৰ্মিকতার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তবে সেই বিজ্ঞাপনের সত্যতা বিচার করবার অধিকার আত্মসম্মানের জন্য সমাজের গ্রহণ করা কর্তব্য এ কথা মানতেই হবে । পরদিন তিনটে-রাত্রে উঠতে হল, চারটের সময় যাত্রা । ১৩ই এপ্ৰেল তারিখে সকাল সাড়ে-আটটার সময় বুশেয়ারে পৌছনো গেল । বুশেয়ারের গবর্নর আমাদের আতিথ্যভার নিয়েছেন । যত্নের সীমা নেই। মাটির মানুষের সঙ্গে আকাশের অন্তরঙ্গ পরিচয় হল, মনটা কী বললে এই অবকাশে লিখে রাখি । ছেলেবেলা থেকে আকাশে যে-সব জীবকে দেখেছি তার প্রধান লক্ষণ গতির অবলীলতা । তাদের ডানার সঙ্গে বাতাসের মৈত্রীর মাধুর্য । মনে পড়ে ছাদের ঘর থেকে দুপুর-রৌদ্রে চিলের ওড়া চেয়ে চেয়ে দেখতেমা ; মনে হত দরকার আছে বলে উড়ছে না, বাতাসে যেন তার অবাধ গতির অধিকার আনন্দবিস্তার করে চলেছে । সেই আনন্দের প্রকাশ কেবল যে, পাখার গতিসৌন্দর্যে তা নয়, তার রূপসৌন্দর্যে । নীেকোর পালটাকে বাতাসের মেজাজের সঙ্গে মানান রেখে চলতে হয়, সেই ছন্দ রাখবার খাতিরে পাল দেখতে হয়েছে সুন্দর । পাখির পাখাও বাতাসের সঙ্গে মিল করে চলে, তাই এমন তার সুষমা। আবার সেই পাখায় রঙের সামঞ্জস্যও কত । এই তো হল প্রাণীর কথা, তার পরে মেঘের লীলা- সূর্যের আলো থেকে কত রকম রঙ ছেকে নিয়ে আকাশে বানায় খেয়ালের খেলাঘর ! মাটির পৃথিবীতে চলায় ফেরায় দ্বন্দ্বের চেহারা, সেখানে ভারের রাজত্ব, সকল কাজেই বোঝা ঠেলতে