পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ\ტ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অভ্যর্থনাদলের মধ্যে একজন বৃদ্ধ কবি ছিলেন, আমার চেয়ে দুই-এক বছরের ছোটাে। পঙ্গু হয়ে পড়েছেন, শান্ত স্তন্ধ মানুষটি। তার মুখচ্ছবি ভাবুকতায় আবিষ্ট । ইরাকের মধ্যে ইনিই সব চেয়ে বড়ো কবি বলে ঐর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল ।. অনেকদিন পরে মোটর ছেড়ে রেলগাড়িতে চড়া গেল। গাড়িগুলি আরামের । দেহটা এতকাল পথে পথে কেবলই ঠোকর খেয়ে নাড়া খেয়ে একদণ্ড নিজেকে ভুলে থাকতে পারছিল না, আজ বাহনের সঙ্গে অবিশ্রাম দ্বন্দ্ব তার মিটে গেল । জানালার বাইরে এখনো মাঝে মাঝে ফসলের আভাস দেখা যায়, বোধ হয় যেন কোথাও কোথাও খাল-নালা দিয়ে জলসেকের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মোটের উপরে কঠিন। এখানকার ধূসরবর্ণ মাটি । মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো স্টেশনে অভ্যর্থনার জনতা পেরিয়ে এলুম। যখন শোনা গেল বোগদাদ আর পনেরো মিনিট পথ দূরে তখনো তার পূর্বসূচনা কিছুই নেই, তখনো শূন্য মােঠ ধূ ধু করছে। অবশেষে বোগদাদে এসে গাড়ি থামল । স্টেশনে ভিডের অন্ত নেই। নানা শ্রেণীর প্রতিনিধি এসে আমাকে সম্মান জানিয়ে গেলেন, ভারতীয়েরা দিলেন মালা পরিয়ে । ছোটাে ছোটাে দুটি মেয়ে দিয়ে গেল ফুলের তোড়া । মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে একটি বাঙালি মেয়েকেও দেখলেম । বোগদাদের রাস্তা কতকটা আমাদেরই দেশের দোকান-বাজার-ওয়ালা পথের মতো । একটা বিশেষত্ব আছে, মাঝে মাঝে পথের ধারে কাঠের বেঞ্চি-পাতা চা খাবার এবং মেলামেশা করবার জায়গা । ছোটোখাটো ক্লাবের মতো । সেখানে আসর। জমেছে। এক-এক শ্রেণীর লোক এক-একটি জায়গা অধিকার করে থাকে, সেখানে আলাপের প্রসঙ্গে ব্যাবসার জেরও চলে । শহরের মতো জায়গায় এরকম সামাজিকতাচৰ্চার কেন্দ্ৰ থাকা বিশেষ আবশ্যক সন্দেহ নেই । আগেকার দিনে গল্প বলবার কথক ছিল, তখন তারা এই-সকল পথপ্ৰান্তসভায় কথা শোনাত । আমাদের দেশে যেমন কথকের ব্যাবসা প্ৰায় বন্ধ হয়ে এসেছে, এদের এখানেও তাই । এই বিদ্যাটি ছাপার বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারলে না । মানুষ আপন রচিত যন্ত্রগুলোর কাছে আপনি সহজ শক্তিকে বিকিয়ে দিচ্ছে । টাইগ্রিস নদীর ধারে একটি হােটেলে আমাদের জায়গা হয়েছে । আমার ঘরের সামনে মন্ত ছাদ, সেখানে বসে নদী দেখা যায় । টাইগ্রিস প্রায় গঙ্গার মতোই প্রশস্ত, ওপারে ঘন গাছের সার, খেজুরের বন, মাঝে মাঝে ইমারত । আমাদের ডান দিকে নদীর উপর দিয়ে ব্রিজ চলে গেছে। এই কাঠের ব্রিজ সৈন্য-পারাপারের জন্য গত যুদ্ধের সময় জেনারেল মন্ড অস্থায়ীভাবে তৈরি করিয়েছিলেন । চেষ্টা করছি বিশ্রাম করতে, কিন্তু সম্ভাবনা অল্প । নানারকম অনুষ্ঠানের ফর্দ লম্বা হয়ে উঠছে । সকালে গিয়েছিলুম মজিয়ম দেখতে ; নূতন স্থাপিত হয়েছে, বেশি বড়ো নয়, একজন জর্মান অধ্যাপক এর অধ্যক্ষ । অতি প্ৰাচীন যুগের যে-সব সামগ্ৰী মাটির নীচে থেকে বেরিয়েছে সেগুলি দেখালেন । এ-সমস্ত পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগেকার পরিশিষ্ট । মেয়েদের গহনা, ব্যবহারের পাত্র প্রভৃতি সুদক্ষ হাতে রচিত ও অলংকৃত । অধ্যাপক বলেন, এই জাতের কারুকার্যে স্থূলতা নেই, সমস্ত সুকুমার ও সুনিপুণ | পূর্ববতী দীর্ঘকালের অভ্যাস না হলে এমন শিল্পের উদ্ভব হওয়া সম্ভবপর হত না । এদের কাহিনী নেই জানা, কেবল চিহ্ন আছে। এটুকু বোঝা যায়। এরা বর্বর ছিল না। পৃথিবীর দিনরাত্রির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের স্মরণব্ৰষ্ট এই সব নরনারীর সুখদুঃখের পর্যায় আমাদেরই মতো বয়ে চলত। ধর্মে কর্মে লোকব্যবহারে এদেরও জীবনযাত্রার আর্থিক-পারমার্থিক সমস্যা ছিল বহুবিচিত্র । অবশেষে, কী আকারে ঠিক জানি নে, কোন চরম সমস্যা বিরাটমূর্তি নিয়ে এদের সামনে এসে দাঁড়াল, এদের জ্ঞানী কমী ভাবুক, এদের পুরোহিত, এদের সৈনিক, এদের রাজা, তার কোনো সমাধান করতে পারলে না, অবশেষে ধরণীর হাতে প্ৰাণ যাত্রার সম্বল কিছু কিছু ফেলে রেখে দিয়ে সবাইকে চলে যেতে হল । কোথায় গেল এদের ভাষা, কোথায় এদের সব কবি, এদের প্রতিদিনের বেদনা কোনো ছন্দের মধ্যে কোথাও কি সংগ্ৰহ করা রইল না । কেবল মাত্র আর আট-দশ হাজার বছরের প্রান্তে ভাবীকালে দাড়িয়ে মানুষের আজকের দিনের বাণীর প্রতি যদি কান পাতি, কোনো ধ্বনি কি পৌছবে কানে এসে, যদি-বা পৌঁছয় তার অর্থ কিছু বুঝতে পারব ।