পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ । S মাথা গণনায় যে মানুষটি কেবল এক, হৃদয়ের মধ্যে সে যে সকল গণনার অতীত। শচীশকে কি এক দুই তিনের কোঠায় ফেলা যায় ? সে যে জগমোহনের বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া সমস্ত জগৎকে অসীমতায় ছাঁইয়া ফেলিল । শচীশ কেন গাড়ি আনাইয়া তার উপরে আপনার জিনিস-পত্ৰ তুলিল জগমোহন তাহাকে সে কথা জিজ্ঞাসাও করিলেন না । বাড়ির যে বিভাগে তার বাপ থাকেন। শচীশ সে দিকে গেল না, সে তার এক বন্ধুর মেসে গিয়া উঠিল। নিজের ছেলে যে কেমন করিয়া এমন পর হইয়া যাইতে পারে তাহা স্মরণ করিয়া হরিমোহন বারংবার অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন । তার হৃদয় অত্যন্ত কোমল ছিল। বাড়ি ভাগ হইয়া যাইবার পর পুরন্দর জেদ করিয়া তাহাদের অংশে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করাইল এবং সকালে সন্ধ্যায় শাখঘণ্টার আওয়াজে জগমোহনের কান ঝালাপালা হইয়া উঠিতেছে। ইহাই কল্পনা করিত এবং সে লাফাইতে থাকিত । শচীশ প্রাইভেট টুইশনি লইল এবং জগমোহন একটা এনট্রেন্স স্কুলের হেড়মাস্টারি জোগাড় করিলেন । হরিমোহন এবং পুরন্দর এই নাস্তিক শিক্ষকের হাত হইতে ভদ্রঘরের ছেলেদি বঁাচাইবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন । ( কিছুকাল পরে শচীশ একদিন দোতলায় জগমোহনের পড়বার ঘরে আসিয়া উপস্থিত। ইহাদের মধ্যে প্ৰণাম করিবার প্রথা ছিল না। জগমোহন শচীশকে আলিঙ্গন করিয়া টােকিতে বসাইলেন। বলিলেন, খবর কী ? একটা বিশেষ খবর ছিল । ননিবালা তার বিধবা মায়ের সঙ্গে তার মামার বাড়িতে আশ্রয় লইয়াছিল। যতদিন তার মা বাচিয়া ছিল কোনাে বিপদ ঘটে নাই। অল্পদিন হইল মা মরিয়াছে। মামাতো ভাইগুলো দুশ্চরিত্র। তাহাদেরই এক বন্ধু ননিবালাকে তার আশ্রয় হইতে বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছিল। কিছুদিন বাদে ননির পরে তার সন্দেহ হইতে থাকে এবং সেই ঈর্ষায় তাহাকে অপমানের একশেষ করে। যে বাড়িতে শচীশ মাস্টারি করে তারই পাশের বাড়িতে এই কাণ্ড। শচীশ এই হতভাগিনীকে উদ্ধার করিতে চায়। কিন্তু তার না আছে অর্থ না আছে ঘর-দুয়ার, তাই সে তার জ্যাঠার কাছে আসিয়াছে। এ দিকে মেয়েটির সন্তান-সম্ভাবনা । . জগমোহন তো একেবারে আগুন । সেই পুরুষটাকে পাইলে এখনই তার মাথা গুড়া করিয়া দেন এমনি তঁর ভাব । তিনি এ-সব ব্যাপারে শান্ত হইয়া সকল দিক চিন্তা করিবার লোক নন । একেবারে ব্লগ বসলেন, তা লে তো, আমার লাইব্রেরি ও খািল আছে, সেইখন আমি তাকে থাকতে শচীশ আশ্চর্য হইয়া কহিল, লাইব্রেরি-ঘর ! কিন্তু, বইগুলো ? যতদিন কাজ জোটে নাই কিছু কিছু বই বিক্রি করিয়া জগমোহন দিন চালাইয়াছেন। এখন অল্প যা বই বাকি আছে তা শোবার ঘরেই ধরিবে । ". জগমোহন বলিলেন, মেয়েটিকে এখনই লইয়া এসো। : শচীশ কহিল, তাকে আনিয়াছি, সে নীচের ঘরে বসিয়া আছে। । - জগমোহন নামিয়া আসিয়া দেখিলেন, সিঁড়ির পাশের ঘরে একখানা কাপড়ের পুঁটুলির মতো জড়োসড়ো হইয়া মেয়েটি এক কোণে মাটির উপরে বসিয়া আছে। । জগমোহন ঝড়ের মতো ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া তার মেঘগম্ভীর গলায় বলিয়া উঠিলেন, এসো, আমার মা এসো। ধুলায় কেন বসিয়া! . r মেয়েটি মুখের উপর আঁচল চাপিয়া ধরিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কঁদিতে লাগিল। জগমোহনের চােখে সহজে জল আসে না ; তার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। তিনি শচীশকে