পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88O রবীন্দ্র-রচনাবলী নিন্তব্ধতা। তাঁহারই সুরে পরিপূর্ণ হইয়া ছিল। যেন স্বপ্নে চলিতেছিলাম, খোলা আকাশে বাধা পাই নাই- কঠিন কলিকাতায় আসিয়া মাথা ঠুকিয়া গেল, মানুষের ভিড়ের ধাক্কা খাইলাম- চট্ৰকা ভাঙিয়া গেল। একদিন যে এই কলিকাতার মেসে দিনরাত্রি সাধনা করিয়া পড়া করিয়ছি, গোলদিঘিতে বন্ধুদের সঙ্গে মিলিয়া দেশের কথা ভাবিয়াছি, রাষ্ট্রনৈতিক সম্মিলনীতে ভলানটিয়ারি করিয়াছি, পুলিসের অন্যায় অত্যাচার নিবারণ করিতে গিয়া জেলে যাইবার জো হইয়াছে; এইখানে জ্যাঠামশায়ের ডাকে সাড়া দিয়া ব্ৰত লইয়াছি যে, সমাজের ডাকাতি প্ৰাণ দিয়া ঠেকাইব, সকল রকম গোলামির জাল কাটিয়া দেশের লোকের মনটাকে খালাস করিব ; এইখনকার মানুষের ভিতর দিয়া বুক ফুলাইয়া চলিয়া যায় যৌবনের শুরু হইতে আজ পর্যন্ত তেমনি করিয়া চলিয়াছি; ক্ষুধাতৃষ্ণা সুখদুঃখ ভালেমদের বিচিত্র সমস্যায় পাক-খাওয়া মানুষের ভিড়ের সেই কলিকাতায় অশ্রুবাম্পাচ্ছন্ন রসের বিহবলতা জাগাইয়া রাখিতে প্ৰাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলাম। ক্ষণে ক্ষণে মনে হইতে লাগিল, আমি দুর্বল, আমি অপরাধ করিতেছি, আমার সাধনার জোর নাই। শচীশের দিকে তাকাইয়া দেখি, কলিকাতা শহরটা যে দুনিয়ার ভুবৃত্তান্তে কোনো-একটা জায়গায় আছে এমন চিহ্নই তার মুখে নাই, তার কাছে। এ সমস্তই ছায়া । r Vt শিবতোষের বাড়িতে গুরুর সঙ্গেই একত্র আমরা দুই বন্ধু বাস করিতে লাগিলাম। আমরাই তীর প্রধান শিষ্য, তিনি আমাদিগকে কাছছাড়া করিতে চাহিলেন না। গুরুকে লইয়া গুরুভাইদের লইয়া দিনরাত রসের ও রসাতত্ত্বের আলোচনা চলিল । সেই-সব গভীর দুৰ্গম কথার মাঝখানে হঠাৎ এক-একবার ভিতরের মহল হইতে একটি মেয়ের গলার উচ্চহাসি আসিয়া পীেছিত। কখনো কখনো শুনিতে পাইতাম একটি উচ্চসুরের ডাক— ‘‘বামি । আমরা ভাবের যে আশমানে মনটাকে বুদ করিয়া দিয়াছিলাম তার কাছে এগুলি অতি তুচ্ছ, কিন্তু হঠাৎ মনে হইত অনাবৃষ্টির মধ্যে যেন ঝর ঝর করিয়া এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গেল। আমাদের দেয়ালের পাশের অদৃশ্যলোক হইতে ফুলের ছিন্ন পাপড়ির মতো জীবনের ছোটাে ছােটাে পরিচয় যখন আমাদিগকে স্পর্শ করিয়া যাইত তখন আমি মুহুর্তের মধ্যে বুঝিতাম, রসের লোক তো ঐখানেই- যেখানে সেই বামির আঁচলে ঘরকন্নার চাবির গোচ্ছা বাজিয়া ওঠে, যেখানে রান্নাঘর হইতে রান্নার গন্ধ উঠিতে থাকে, যেখানে ঘর ঝাঁট দিবার শব্দ শুনিতে পাই, যেখানে সব তুচ্ছ কিন্তু সব সত্য, সব মধুরে তীব্রে স্কুলে সূক্ষ্মে মাখামাখি- সেইখানেই রসের স্বৰ্গ । বিধবার নাম ছিল দামিনী । তাকে আড়ালো-আবড়ালে ক্ষণে ক্ষণে চকিতে দেখিতে পাইতাম । আমরা দুই বন্ধু গুরুর এমন একাত্ম ছিলাম যে অল্পকালের মধ্যেই আমাদের কাছে দামিনীর আর আড়াল-আবড়াল রহিল না। -- দামিনী যেন শ্রাবণের মেঘের ভিতরকার দামিনী। বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ; অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠিতেছে। ননিবালার মধ্যে আমি নারীর এক বিশ্বরূপ দেখিয়াছি- অপবিত্রের কলঙ্ক যে নারী আপনাতে গ্ৰহণ করিয়াছে, পাপিষ্ঠের জন্য যে নারী জীবন দিয়া ফেলিল, যে নারী মরিয়া জীবনের সুধাপাত্র পূর্ণতর করিল। দামিনীর মধ্যে নারীর আর-এক বিশ্বরূপ দেখিয়াছি; সে নারী মৃত্যুর কেহ নয়, সে জীবনরসের রসিক। বসন্তের পুষ্পবনের মতো লাবণ্য গন্ধে হিল্লোলে সে কেবলই ভরপুর হইয়া উঠিতেছে ; সে কিছুই ফেলিতে চায় না, সে সন্ন্যাসীকে ঘরে স্থান দিতে নারাজ ; সে উত্ত্বরে হাওয়াকে সিকি-পয়সা খাজনা দিবে না পণ করিয়া বসিয়া আছে। ,