পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8v8 রবীন্দ্র-রচনাবলী দিলে। আমরা কি কেবল লক্ষ্মী, আমরাই তো ভারতী । সেদিন একটা অপূর্ব আনন্দ এবং অহংকারের দীপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলুম। ভিতরে একটা আগুনের ঝড়ের বেগ আমাকে এক মুহুর্তে এক কেন্দ্র থেকে আর-এক কেন্দ্ৰে টেনে নিয়ে গেল। আমার ইচ্ছা করতে লািগল গ্ৰীসের বীরাঙ্গনার মতো আমার চুল কেটে দিই ঐ বীরের হাতের ধনুকের ছিলা করবার জন্য, আমার এই আজানুলম্বিত চুল। যদি ভিতরকার চিত্তের সঙ্গে বাইরেকার গয়নার যোগ থাকত তা হলে আমার কন্ঠী, আমার গলার হার, আমার বাজুবন্ধ উল্কাবৃষ্টির মতো সেই সভায় । ছুটি ছুটে খসে খসে পড়ে যেত। নিজের অত্যন্ত একটা ক্ষতি করতে পারলে তবেই যেন সেই আনন্দের উৎসাহবেগ সহ্য করা সম্ভব হতে পারত। সন্ধ্যাবেলায় আমার স্বামী যখন ঘরে এলেন আমার ভয় হতে লাগল পাছে তিনি সেদিনকার বক্তৃতার দীপক রাগিণীর সঙ্গে তান না মিলিয়ে কোনাে কথা বলেন, পাছে তার সত্যপ্রিয়তায় কোনাে জায়গায়, ঘা লাগাতে তিনি একটুও অসম্মতি প্রকাশ করেন- তা হলে সেদিন আমি তাকে স্পষ্ট অবজ্ঞা করতে পারতুম | কিন্তু, তিনি আমাকে কোনো কথাই বললেন না । সেটাও আমাকে ভালো লাগল না। তঁরা উচিত ছিল বলা, আজ সন্দীপের কথা শুনে আমার চৈতন্য হল এ-সব বিষয়ে আমার অনেক দিনের ভুল ভেঙে গেল। আমার কেমন মনে হল তিনি কেবল জেদ করে চুপ করে আছেন, জোর করেই উৎসাহ প্ৰকাশ করছেন না । 缸 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, সন্দীপবাবু আর কতদিন এখানে আছেন ? স্বামী বললেন, তিনি কাল সকালেই রংপুরে রওনা হবেন। কাল সকালেই ? ? হ্যা, সেখানে তীর বক্তৃতার সময় স্থির হয়ে গেছে। আমি একটুক্ষণ চুপ করে রইলুম। তার পরে বললুম, কোনােমতে কালকের দিনটা থেকে গেলে श कीं ? সে তো সম্ভব নয়, কিন্তু কেন বলো দেখি । আমার ইচ্ছা আমি নিজে উপস্থিত থেকে তাকে খাওয়াব। 's শুনে আমার স্বামী আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এর পূর্বে অনেক দিন অনেক বার তিনি তীর বন্ধুদের কাছে আমাকে বের হবার জন্যে অনুরোধ করেছেন। আমি কিছুতেই রাজি হই নি। আমার স্বামী আমার মুখের দিকে স্থিরভাবে একরকম করে চাইলেন, আমি তার মানেটা ঠিক বুঝলুম না। ভিতরে হঠাৎ একটু কেমন লজ্জা বোধ হল । বললুম, না না, সে কােজ নেই। তিনি বললেন, কেনই বা কােজ নেই ? আমি সন্দীপকে বলব, যদি কোনোরকমে সম্ভব হয় তা হলে কাল সে থেকে যাবে । দেখলুম, সম্ভব হল । আমি সত্য কথা বলব। সেদিন আমার মনে হচ্ছিল ঈশ্বর কেন আমাকে আশ্চর্য সুন্দর করে গড়লেন না ? কারও মন হরণ করবার জন্যে যে, তা নয়। কিন্তু, রূপ যে একটা গৌরব । আজ এই মহাদিনে দেশের পুরুষেরা দেশের নারীর মধ্যে দেখুক একবার জগদ্ধাত্রীকে । কিন্তু, বাইরের রূপ না হলে তাদের চোখ যে দেবীকে দেখতে পায় না। সদীপবাবু কি আমার মধ্যে দেশের সেই জাগ্রত শক্তিকে দেখতে পাবেন ? না, মনে করবেন, এ একজন সামান্য মেয়েমানুষ, তীর এই বন্ধুর ঘরের গৃহিণী।মাত্র ? সেদিন সকালে মাথা ঘষে আমার সুদীর্ঘ এলোচুল একটি লাল রেশমের ফিতে দিয়ে নিপুণ করে জড়িয়েছিলুম। দুপুরবেলায় খাবার নিমন্ত্রণ, তাই ভিজে চুল তখন খোপা করে বাঁধবার সময় ছিল না। গায়ে ছিল জরির পাড়ের একটি সাদা মাদ্রাজী শাড়ি, আর জরির একটুখানি পাড়-দেওয়া হাত-কটা জ্যাকেট ।