পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Goo রবীন্দ্র-রচনাবলী । নিখিল জিজ্ঞাসা করলে, কার হুকুম নেই ? মক্ষমী বললে, তা কেমন করে বলব ! রাগে ক্ষোভে মন্ধীর চােখ দিয়ে জল পড়ে-পড়ে আর-কি। . দরোয়ানকে নিখিল ডেকে পাঠালে। সে বললে, হুজুর, আমার তো কসুর নেই। হুকুম তামিল করেছি। ” ዶ কার হুকুম ? ক্ষণকালের জন্যে সবাই আমরা চুপ করে রইলুম। দরোয়ান চলে গেলে মন্ধী বললে, ননকুকে ছাড়িয়ে দিতে হবে। নিখিল চুপ করে রইল। আমি বুঝলুম ওর ন্যায় বুদ্ধিতে খটকা লাগল। ওর খটকার আর অন্ত নেই। · কিন্তু বড়ো শক্ত সমস্যা ! সোজা মেয়ে তো নয়। ননকুকে ছাড়ানোর উপলক্ষে জায়েদের উপর অপমানের শোধ তোলা চাই । , নিখিল চুপ করেই রইল। তখন মক্ষীর চােখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়তে লাগল। নিখিলের ভালোমানুষের পরে তার ঘূণার আর অন্ত রইল না। নিখিল কোনো কথা না বলে উঠে ঘর থেকে চলে গেল। পরদিন সেই দরোয়ানকে দেখা গেল না। খবর নিয়ে শুনলুম, তাকে নিখিল মফস্বলের কোন কাজে । নিযুক্ত করে পাঠিয়েছে— দরোয়ানজির তাতে লাভ বৈ ক্ষতি হয় নি। এইটুকুর ভিতরে নেপথ্যে কত ঝড় বয়ে গেছে সে তো আভাসে বুঝতে পারছি। বারে বারে কেবল এই কথাই মনে হয়।— নিখিল অদ্ভুত মানুষ, একেবারে সৃষ্টিছাড়া। এর ফল হল এই যে, এর পরে কিছুদিন মক্ষী রোজই বৈঠকখানায় এসে বেহারাকে দিয়ে আমাকে ডাকিয়ে এনে আলাপ করতে আরম্ভ করলে ; কোনােরকম প্রয়ােজনের কিংবা আকস্মিকতার ছুতোটুকু পর্যন্ত রাখলে না । এমন করেই ভাবভঙ্গি ক্ৰমে আকার-ইঙ্গিতে, অস্পষ্ট ক্রমে স্পষ্টতায়, জমে উঠতে থাকে। এ যে ঘরের বউ, বাইরের পুরুষের পক্ষে একেবারে নক্ষত্ৰলোকের মানুষ। এখানে কোনাে বাধা পথ নেই। এই পথহীন শূন্যের ভিতর দিয়ে ক্রমে ক্রমে টানাটানি, জানাজানি, অদৃশ্য হাওয়ায় হাওয়ায় সংস্কারের পর্দা একটার পর আর-একটা উড়িয়ে দিয়ে কোন এক সময়ে একেবারে উলঙ্গ প্রকৃতির মাঝখানে এসে পৌঁছনো- সত্যের এ এক আশ্চর্য জয়যাত্ৰা ! সত্য নয় তো কী ! স্ত্রীপুরুষের পরস্পরের যে মিলের টান, সেটা হল একটা বাস্তব জিনিস ; ধুলোর কণা থেকে আরম্ভ করে আকাশের তারা পর্যন্ত জগতের সমস্ত বস্তুপুঞ্জ তার পক্ষে ; আর, মানুষ তাকে কতকগুলো বচন দিয়ে আড়ালে রাখতে চায়, তাকে ঘরগড়া বিধিনিষেধ দিয়ে নিজের ঘরের জিনিস করে বানাতে বসেছে! যেন সৌরজগৎকে গলিয়ে জামাইয়ের জন্যে ঘড়ির চেন করবার ফর্মশি। তার পরে বাস্তব যেদিন বস্তুর ডাক শুনে জেগে ওঠে, মানুষের সমস্ত কথার ফাঁকি এক মুহুর্তেই উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আপনার জায়গায় এসে দাঁড়ায়, তখন ধর্ম বলো, বিশ্বাস বলো, কেউ কি তাকে ঠেকাতে পারে ? তখন কত ধিক্কার, কত হাহাকার, কত শাসন ! কিন্তু ঝড়ের সঙ্গে ঝগড়া করবে কি শুধু মুখের কথায় ? সে তো জবাব দেয় না, সে শুধু নাড়া দেয়— সে যে বাস্তব। তাই চোখের সামনে সত্যের এই প্ৰত্যক্ষ প্রকাশ দেখতে আমার ভারি চমৎকার লাগছে। কত লজ্জা, কত ভয়, কত দ্বিধা ! তাই যদি না থাকবে। তবে সত্যের রাসা রইল কী ? এই-যে পা কঁাপিতে থাকা, এই যে থেকে-থেকে মুখ ফেরানো, এ বড়ো মিষ্টি ! "আর, এই ছলনা শুধু অন্যকে নয়, নিজেকে। বাস্তবকে যখন অবাস্তবের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তখন ছলনা। তার প্রধান অস্ত্ৰ। কেননা,