পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○の8 রবীন্দ্র-রচনাবলী চন্দ্রনাথবাবু ঘরে ঢুকেই সংকুচিত হয়ে ফিরে যাবার চেষ্টা করছিলেন- ‘মাপ করবেন। আমি'- কথাটা শেষ করতে না করতেই মক্ষী তীর পায়ের কাছে নত হয়ে প্ৰণাম করলে আর বললে, মাস্টারমশায়, যাবেন না, আপনি বসুন। সে যেন ডুব-জলে পড়ে গেছে, মাস্টারমশায়ের আশ্রয় চায় । ভীরু ! কিংবা আমি হয়তো ভুল বুঝছি। এর ভিতরে হয়তো একটা ছলনা আছে। নিজের দাম বাড়াবার ইচ্ছা । মক্ষী হয়তো আমাকে আড়ম্বর করে জানাতে চায় যে, তুমি ভাবিছ তুমি আমাকে অভিভূত করে দিয়েছ, কিন্তু তোমার চেয়ে চন্দ্রনাথবাবুকে আমি ঢের বেশি শ্রদ্ধা করি — তাই চাই নে | আমি তো বলেইছি, ফাকিতে আমার পেট ভরবে না— আমি বস্তু চিনি । চন্দ্রনাথবাবু স্বদেশীর কথা তুললেন ; আমার ইচ্ছে ছিল তাকে একটানা বকে যেতে দেব, কোনো জবাব করব না । বুড়োমানুষকে কথা কইতে দেওয়া ভালো ; তাতে তাদের মনে হয় তারাই বুঝি সংসারের কলে দম দিচ্ছে, বেচারারা জানতে পারে না তাদের রসনা যেখানে চলছে সংসার তার থেকে অনেক দূরে চলছে। প্রথমে খানিকটা চুপ করেই ছিলুম, কিন্তু সন্দীপচন্দ্রের ধৈর্য আছে। এ বদনাম তার পরম শত্রুরাও দিতে পারবে না । চন্দ্রনাথবাবু যখন বললেন, দেখুন, আমরা কোনোদিনই চাষ করি নি, আজ এখনই হাতে হাতে ফসল পাব এমন আশা যদি করি তবে আমি থাকতে পারলুম না ; আমি বললুম, আমরা তো ফসল চাই নে ! আমরা বলি, মা ফলেষু কদাচন ; চন্দ্রনাথবাবু আশ্চর্য হয়ে গেলেন ; বললেন, তবে আপনারা কী চান ? আমি বললুম, কাঁটাগাছ, যার আবাদে কোনো খরচ নেই। মাস্টারমশায় বললেন, কাটগাছ পরের রাস্তা কেবল বন্ধ করে না, নিজের রাস্তাতেও সে জঞ্জাল । নে ; আমাদের বুক জুলছে, এখন সেইটেই বড়ো কথা । এখন আমরা পরের পায়ের তেলের কথা মনে রেখেই পথে কাটা দেব ; তার পরে যখন নিজের পায়ে বিধবে তখন নাহয় ধীরে সুস্থে অনুতাপ করা যাবে ; সেটা এমনিই কি বেশি ? মরবার বয়স যখন হবে তখন ঠাণ্ডা হবার সময় হবে, যখন চন্দ্রনাথবাবু একটু হেসে বললেন, ছটফট করতে চান করুন, কিন্তু সেইটেকেই বীরত্ব কিংবা কৃতিত্ব মনে করে নিজেকে বাহবা দেবেন না । পৃথিবীতে যে জাত আপনার জাতকে বঁচিয়েছে তারা ছটফট করে নি, তারা কাজ করেছে ! কাজটাকে যারা বরাবর বাঘের মতো দেখে এসেছে তারাই আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠেই মনে করে আকাজের অপথ দিয়েই তারা তাড়াতাড়ি সংসারে তরে যাবে । খুব একটা কড়া জবাব দেবার জন্যই যখন কোমর বেঁধে দাঁড়াচ্ছি এমন সময় নিখিল এল । বইটার কথা বলছিলুম। পৃথিবীর সাড়ে পনেরো-আনা মানুষকে মিথ্যের দ্বারা ফাকি দিতে হয়। আর এই ইস্কুলমাস্টারের চিরকেলে ছাত্রটিকে সত্যের দ্বারা ফাকি দেওয়াই সহজ । নিখিলকে জেনেশুনে ঠকতে দিলেই তবে ও ভালো করে ঠিকে । তাই ওর সঙ্গে দেখা-বিস্তির খেলাই ভালো খেলা । নিখিল বইটার নাম পড়ে দেখে চুপ করে রইল। আমি বললুম, মানুষ নিজের এই বাসের পৃথিবীটাকে নানান কথা দিয়ে ভারি অস্পষ্ট করে তুলেছে, এই-সব লেখকেরা ঝাটা হাতে করে উপরকার ধুলো উড়িয়ে দিয়ে ভিতরকার বস্তুটাকে স্পষ্ট করে তোেলবার কাজে লেগেছে ; তাই আমি বলছিলুম, এ বইটা তোমার পড়ে দেখা ভালো । নিখিল বললে, আমি পড়েছি । আমি বললুম, তোমার কী বোধ হয় ?