পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

లిం রবীন্দ্র-রচনাবলী অবসন্ন হইয়া পড়িয়ছে, সে আর পারিয়া ওঠে না, এখন তাহার মরণ হইলে বঁাচে । এখন আর অধিক লোকজন তাহার কাছে আসিলে তাহার কেমন কষ্ট হয় । সে মনে করে, “আমাকে এইখানে একলা রাখিয়া দিক, আপনার মনে একলা পড়িয়া থাকিয়া মরি।” সে সকল লোকের নানা জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়া উঠিতে আর পারে না । সে সকল বিষয়েই কেমন বিরক্ত উদাসীন হইয়া পড়িয়াছে। রজনী বেচারি কত কঁাদিয়া তাহাকে কত সাধ্য সাধনা করিয়াছে, কিন্তু এই আহত লতাটি জন্মের মতো ত্ৰিয়মাণ হইয়া পড়িয়াছে— বর্ষার সলিলসেকে, বসন্তের বায়ুবীজনে, আর সে মাথা তুলিতে পরিবে: ୩ | a কিন্তু একি সংবাদ ! মহেন্দ্ৰ নরেন্দ্রের সন্ধান আবার পাইয়াছে শুনিতেছি । মহেন্দ্র করুণা ও নরেন্দ্রের জন্য একটি ভালো বাড়ি ভাড়া করিয়াছে। নরেন্দ্ৰ মহেন্দ্রের ব্যয়ে সে বাড়িতে বাস করিতে সহজেই স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু একবার মন ভাঙিয়া গেলে তাঁহাতে আর স্মৃর্তি হওয়া সহজ নহে— করুণা এই সংবাদ শুনিল, কিন্তু তাহার অবসন্ন মন আর তেমন জাগিয়া উঠিল না। করুণা মহেন্দ্রদের বাড়ি হইতে বিদায় হইল- যাইবার দিন রজনী করুণার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কতই কাদিতে লাগিল । করুণা চলিয়া গেলে সে বাড়ি যেন কেমন শূন্য-শূন্য হইয়া গেল। সেই যে করুণা গেল, আর সে ফিরিল না। সে বাড়িতে সেই অবধি করুণার সেই সুমধুর হাসির ধ্বনি একদিনের জন্যও আর শুনা গেল না । ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ পীড়িত অবস্থায় করুণা নরেন্দ্রের নিকট আসিল । মহেন্দ্ৰ প্ৰায় মাঝে মাঝে করুণাকে দেখিতে আসিতেন ; করুণা কখনো খারাপ থাকিত, কখনো ভালো থাকিত । এমনি করিয়া দিন চলিয়া যাইতেছে। নরেন্দ্র করুণাকে মনে মনে ঘূণা করিত, কেবল মহেন্দ্রের ভয়ে এখনাে তাহার উপর কোনে অসদাব্যবহার করিতে আরম্ভ করে নাই। কিন্তু নরেন্দ্র প্রায় বাড়িতে থাকিত না- দুই-এক দিন বাদে যে অবস্থায় বাড়িতে আসিত, তখন করুণার কাছে না। আসিলেই ভালো হইত। তাহার অবর্তমানে পীড়িতা করুণাকে দেখিবার কেহ লোক নাই। কেবল সেই দাসীটি মাঝে মাঝে আসিয়া বিরক্তির স্বরে কহিত, “তোমার কি ব্যামো কিছুতেই সারবে না গা। কী যন্ত্রণা !” নরেন্দ্রর উপর এই দাসীটির মহা আধিপত্য ছিল। নরেন্দ্র যখন মাঝে মাঝে বাড়ি হইতে চলিয়া যাইত, তখন ইহার যত ঈর্ষা হইত, এত আর কাহারও নয়। এমন-কি, নরেন্দ্র বাড়ি ফিরিয়া আসিলে তাহাকে মাঝে মাঝে বঁটাইতে ক্রটি কিরিত না । মাঝে মাঝে নরেন্দ্রের উপর ইহার অভিমানই বা দেখে কে । করুণার উপরেও ইহার ভারি। আক্রোশ ছিল, করুণাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় লইয়া জ্বালাতন করিয়া মারিত। মাঝে মাঝে নরেন্দ্রের সহিত ইহার মহা মারামারি বাধিয়া যাইত- দুজনেই দুজনের উপর গালাগালি ও কিল চাপড় বর্ষণ করিয়া কুরুক্ষেত্র বাধাইয়া দিত। কিন্তু এইরূপ জনশ্রুতি আছে, নরেন্দ্র তাহার বিপদের দিনে ইহার সাহায্যে দিনযাপন করিতেন । নরেন্দ্রের ব্যবহার ক্রমেই স্মৃর্তি পাইতে লাগিল। যখন তখন আসিয়া মাতলামি করিত, সেই দাসীটির সহিত ভারি ঝগড়া বাধাইয়া দিত। করুণা এই সমস্তই দেখিতে পাইত, কিন্তু তাহার কেমন একপ্রকারের ভাব হইয়াছে- সে মনে করে যাহা হইতেছে হউক, যাহা যাইতেছে চন্বিয়া যাক ! দাসীটা মাঝে মাঝে নরেন্দ্রের উপর রাগিয়া করুণার নিকট গরগর করিয়া মুখ নাড়িয়া যাইত ; করুণা চুপ করিয়া থাকিত, কিছুই উত্তর দিত না । নরেন্দ্র আবশ্যকমত গৃহসজ্জা বিক্রয় করিতে লাগিল। অবশেষে তাহাতেও কিছু হইল না- অর্থসাহায্য চাহিয়া মহেন্দ্ৰকে একখানা চিঠি লিখিবার জন্য করুণাকে পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করিল। করুণা বেচারি কোথায় একটু নিশ্চিন্ত হইতে চায়, কোথায় সে মনে করিতেছে “যে যাহা করে করুক- আমাকে একটু একেলা থাকিতে দিক, না, তাহাকে লইয়াই । এই সমস্ত হাঙ্গাম । সে কী করে, মাঝে মাঝে লিখিয়া দিত। কিন্তু বার বার এমন কী করিয়া লিখিবে ।