পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মহাত্মা গান্ধী ܬܠܓ হল। পণ্ডিত শ্যামশাস্ত্রী বেদ পাঠ করলেন। তার পর মহাত্মজি শ্ৰীমতী কন্তুরীবাঈয়ের হাত হতে ধীরে ধীরে লেবুর রস পান করলেন । পরিশেষে সবরমতী-আশ্রমবাসীগণ এবং সমবেত সকলে বৈষ্ণব জন কো’ গানটি গাইলেন । ফল ও মিষ্টান্ন বিতরণ হল, সকলে গ্রহণ করলেম | জেলের অবরোধের ভিতর মহােৎসব। এমন ব্যাপার। আর কখনো ঘটে নি। প্ৰাণোৎসর্গের যজ্ঞ হল জেলখানায়, তার সফলতা এইখানেই রূপ ধারণ করলে। মিলনের এই অকস্মাৎ আবির্ভূত অপরূপ মূর্তি, একে বলতে পারি যজ্ঞসম্ভবা। রাত্রে পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জীরু প্রমুখ পুনার সমবেত বিশিষ্ট নেতারা এসে আমাকে ধরলেন, পরদিন মহাত্মজির বার্ষিকী উৎসবসভায় আমাকে সভাপতি হতে হবে ; মালব্যজিও বোম্বাই হতে আসবেন । মালব্যজিকেই সভাপতি করে আমি সামান্য দু-চার কথা লিখে পড়ব, এই প্রস্তাব করলেম। শরীরের দুর্বলতাকেও অস্বীকার করে শুভদিনের এই বিরাট জনসভায় যোগ দিতে রাজি না হয়ে পারলেম না। বিকালে শিবাজিমন্দির-নামক বৃহৎ মুক্ত অঙ্গনে বিরাট জনসভা । অতি কষ্টে ভিতরে প্রবেশ করলেম । ভাবলেম, অভিমন্যুর মতো প্রবেশ তো হল, বেরোবার কী উপায় । মালব্যজি উপক্ৰমণিকায় সুন্দর করে বােঝালেন তীর বিশুদ্ধ হিন্দি ভাষায় যে, অস্পৃশ্যবিচার হিন্দুশাস্ত্রসংগত নয়। বহু সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করে তীর যুক্তি প্রমাণ করলেন। আমার কণ্ঠ ক্ষীণ, সাধ্য নেই। এত বড়ো সভায় আমার বক্তব্য শ্রুতিগোচর করতে পারি। মুখে মুখে দু-চারটি কথা বললেম, পরে রচনা পাঠ করবার ভার নিলেন পণ্ডিতজির পুত্ৰ গোবিন্দ মালব্য। ক্ষীণ অপরান্ধুের আলোকে অদৃষ্টপূর্ব রচনা অনর্গল আমন সুস্পষ্ট কণ্ঠে পড়ে গেলেন, এতে বিস্মিত হলেম । আমার সমগ্র রচনা কাগজে আপনারা দেখে থাকবেন। সভায় প্রবেশ করবার অনতিপূর্বে তার পাণ্ডুলিপি জেলে গিয়ে মহাত্মজির হাতে দিয়ে এসেছিলেম। r মতিলাল নেহেরুর পত্নী কিছু বললেন তীর ভ্রাতা-ভগিনীদের উদ্দেশ করে, সামাজিক সাম্যবিধানের ব্ৰত রক্ষায় তাদের যেন একটুও ক্রটি না ঘটে । শ্ৰীযুক্ত রাজাগোপালাচারী, রাজেন্দ্ৰপ্ৰসাদ প্রমুখ অন্যান্য নেতারাও অন্তরের ব্যথা দিয়ে দেশবাসীকে সামাজিক অশুচি দূর করতে আবাহন করলেন। সভায় সমবেত বিরাট জনসংঘ হাত তুলে অস্পৃশ্যতা-নিবারণের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন । বোঝা গেল, সকলের মনে আজকের বাণী পৌঁচেছে। কিছুদিন পূর্বেও এমন দুরূহ সংকল্পে এত সহস্ৰ লোকের অনুমোদন সম্ভব ছিল না । আমার পালা শেষ হল। পরদিন প্ৰাতে মহাত্মাজির কাছে অনেকক্ষণ ছিলেম । তার সঙ্গে এবং মালব্যজির সঙ্গে দীর্ঘকাল নানা বিষয়ে আলোচনা হল । একদিনেই মহাত্মাজি অপ্রত্যাশিত বল লাভ করেছেন । কণ্ঠস্বর তার দৃঢ়তর, blood pressure প্রায় স্বাভাবিক। অতিথি অভ্যাগত অনেকেই আসছেন প্ৰণাম করে আনন্দ জানিয়ে যেতে । সকলের সঙ্গেই হেসে কথা কইছেন । শিশুর দল ফুল নিয়ে আসছে, তাদের নিয়ে তঁর কী আনন্দ । বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক সাম্যবিধান প্রসঙ্গে নানাবিধ আলোচনা চলছে। এখন তীর প্রধান চিন্তার বিষয় হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-ভঞ্জন । আজ যে-মহাত্মার জীবন আমাদের কাছে বিরাট ভূমিকায় উজ্জ্বল হয়ে দেখা, দিল, তাতে সর্বমানুষের মধ্যে মহামানুষকে প্রত্যক্ষ করবার প্রেরণা আছে। সেই প্রেরণা সার্থক হােক ভারতবর্ষের সবত্র । মুক্তিসাধনার সত্য পথ মানুষের ঐক্যসাধনায়। রাষ্ট্রক পরাধীনতা আমাদের সামাজিক সহস্ৰ ভেদবিচ্ছেদকে অবলম্বন করেই পুষ্ট । ” জড়প্রথার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে উদার ঐক্যের পথে মানবসভ্যতা অগ্রসর হবে, সেইদিন আজ সমাগত । অগ্রহায়ণ ১৩৩৯