পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পল্লীপ্ৰকৃতি VVS আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে না, দেবতা তাদের সহায়তা করেন না। দেবাঃ দুর্বলঘাতকাঃ । দুর্বলতা অপরাধ। কেননা, তা বহুল পরিমাণে আত্মকৃত, সম্পূর্ণ আকস্মিক নয় । দেবতা এই অপরাধ ক্ষমা করেন না । অনেক মার খেয়েছি, দেবতার কাছে এই শিক্ষার অপেক্ষায় । চৈতন্যের দুটি পস্থা আছে। এক হচ্ছে মহাপুরুষদের মহাবাণী । তারা মানবপ্রকৃতির গভীরতলে চৈতন্যকে উদবোধিত করে দেন। তখন বহুধা শক্তি সকল দিক থেকেই জেগে ওঠে, তখন সকল কাজই সহজ হয়। আবার দুঃখের দিনও শুভদিন। তখন বাহিরের উপর নির্ভরের মোহ দূর হয়, তখন নিজের মধ্যে নিজের পরিত্রাণ খুঁজতে প্ৰাণপণে উদ্যত হয়ে উঠি । একান্ত চেষ্টায় নিজের কাছে কী করে আনুকূল্য দাবি করতে হয়। অন্য দেশে তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাচ্ছি। ইংলন্ড। আজ যখন দৈন্যের দ্বারা আক্রান্ত তখন সে ঘোষণা করেছে, দেশের লোকে যথাসাধ্য নিজের উৎপন্ন দ্রব্যই নিজেরা ব্যবহার করবে। পথে পথে ঘরে ঘরে এই ঘোষণা যে, দেশজাত পণ্যদ্রব্যই আমাদের মুখ্য অবলম্বন । বহুদিনের বহু-অন্ন-পুষ্ট জাতের মধ্যে যখনই বেকার-সমস্যা উপস্থিত হল। তখনই দেশের ধন নিরন্নদের বাচাতে লেগেছে। এর থেকে দেখা যায়। সেখানে দেশের লোকের সকলের চেয়ে বড়ো সম্পদ দেশব্যাপী আত্মীয়তা । তাদের উপরে আনুকূল্য রয়েছে সদাজাগ্ৰত । তাতে মনের মধ্যে ভরসা হয় । আমরা বেকার হয়ে মরছি। অথচ কেউ আমাদের খবর নেবে না, এ কোনোমতেই হতে পারে না, এই তাদের দৃঢ় বিশ্বাস । এই বিশ্বাসে তাদের এত ভরসা। আমাদের ভরসা নেই। মারী, রোগ, দুৰ্ভিক্ষ, জাতিকে অবসন্ন করে দিয়েছে। কিন্তু প্রেমের সাধনা কই, সেবার উদ্যোগ কোথায় । যে বৃহৎ স্বাৰ্থ বুদ্ধিতে বড়ো রকম করে আত্মরক্ষা করতে হয় সে আমাদের কোথায় । চোখ বুজে অনেক তুচ্ছ বিষয়ে আমরা বিদেশীর অনেক নকল করেছি, আজ দেশের প্রাণান্তিক দৈন্যের দিনে একটা বড়ো বিষয়ে ওদের অনুবর্তন করতে হবে— কোমর বেঁধে বলতে চাই, কিছু সম্বল যথাসাধ্য রক্ষা করতে হবেই। বিদেশে প্রভূত পরিমাণ অর্থ চলে যাচ্ছে, সব তার ঠেকাবার শক্তি আমাদের হাতে এখন নেই, কিন্তু একান্ত চেষ্টায় যতটা রক্ষা করা সম্ভব তাতে যদি শৈথিল করি। তবে সে অপরাধের ক্ষমা নেই। দেশের উৎপাদিত পদার্থ আমরা নিজে ব্যবহার করব । এই ব্ৰত সকলকে গ্ৰহণ করতে হবে । দেশকে আপন করে উপলব্ধি করবার এ একটি প্রকৃষ্ট সাধনা। যথেষ্ট উদ্যবৃত্ত অন্ন যদি আমাদের থাকত- অন্তত এতটুকুও যদি থাকত যাতে দেশের অজ্ঞান দূর হয়, রোগ দূর হয়, দেশের জলকষ্ট পথকষ্ট বাসকষ্ট দূর হয়, দেশের স্ত্রীমারী শিশুমায়ী দূর হতে পারত, তা হলে দেশের অভাবের দিকেই দেশকে এমন একান্তভাবে নিবিষ্ট হতে বলতুম না । কিন্তু আত্মঘাত এবং আত্মগ্লানি থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে সমস্ত চেষ্টাকে যদি উদ্যত না করি, আদ্যকার বহু দুঃখ বহু অবমাননার শিক্ষা যদি ব্যর্থ হয়, তবে মানুষের কাছ থেকে ঘূণা ও দেবতার কাছ থেকে অভিশাপ আমাদের জন্যে নিত্য নির্দিষ্ট হয়ে থাকবে, যে পর্যন্ত আমাদের জীর্ণ হাড় কখানা ধুলার মধ্যে মিশিয়ে না যায়। ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ Čba Svetov