পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পত্নীপ্ৰকৃতি ७११ শ্ৰীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ শ্ৰীনিকেতনের কর্মীদের সভায় কথিত আমার যা বলবার ছিল তা অনেকবার বলেছি, কিছু বাকি রাখি নি। তখন শরীরে শক্তি ছিল, মনে ভাবের প্রবাহ ছিল অবারিত । এখন অস্বাস্থ্য ও জরাতে আমার শক্তিকে খর্ব করেছে, এখন আমার কাছে তোমরা বেশি কিছু প্ৰত্যাশা কোরো না । আমি এখানে অনেকদিন পরে এসেছি। তোমাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়— আমার উপস্থিতি ও সঙ্গমাত্র তোমাদের দিতে পারি। প্রথম যখন এই বাড়ি কিনলুম তখন মনে কোনো বিশেষ সংকল্প ছিল না। এইটুকু মাত্র তখন মনে হয়েছিল যে, শান্তিনিকেতন লোকালয়ের থেকে বিচ্ছিন্ন। দূর দেশ থেকে সমাগত ভদ্রলোকের ছেলেদের পাস করবার মতো বিদ্যাদানের ব্যবস্থা সেখানে আছে, আর সেই উপলক্ষে শিক্ষাবিভাগের বরাদ্দ বিদ্যার কিছু বেশি দেবার চেষ্টা হয় মাত্র । শান্তিনিকেতনের কাজের মধ্যেও আমার মনে আর-একটি ধারা বইছিল । শিলাইদা পতিসর এই-সব পল্লীতে যখন বাস করতুম তখন আমি প্ৰথম পল্পীজীবন প্রত্যক্ষ করি । তখন আমার ব্যবসায় ছিল জমিদারি । প্ৰজারা আমার কাছে তাদের সুখ-দুঃখ নালিশ-আবদার নিয়ে আসত। তার ভিতর থেকে পল্লীর ছবি আমি দেখেছি। এক দিকে বাইরের ছবি— নদী, প্ৰান্তর, ধানখেত, ছায়াতরুতলে মৃত্যু আর একদিকে তাদের অন্তরের কথা। তাদের কােনও আমার কাজের সঙ্গে জড়িত 刃(歼际51 আমি শহরের মানুষ, শহরে আমার জন্ম । আমার পূর্বপুরুষেরা কলকাতার আদিম বাসিন্দা । পল্লীগ্রামের কোনো স্পর্শ আমি প্রথম-বয়সে পাই নি । এইজন্য যখন প্রথম আমাকে জমিদারির কাজে নিযুক্ত হতে হল তখন মনে দ্বিধা উপস্থিত হয়েছিল, হয়তো আমি এ কাজ পারব না, হয়তো আমার কর্তব্য আমার কাছে অপ্রিয় হতে পারে । জমিদারির কাজকর্ম, হিসাবপত্র, খাজনা-আদায়, জন্মা-ওয়াশীল- এতে কোনোকালেই অভ্যন্ত ছিলুম না ; তাই অজ্ঞতার বিভীষিকা আমার মনকে আচ্ছন্ন করেছিল । সেই অঙ্ক ও সংখ্যার বাধনে জড়িয়ে পড়েও প্রকৃতিস্থ থাকতে পারব। এ কথা তখন ভাবতে পারি নি । কিন্তু কাজের মধ্যে যখন প্রবেশ করলুম, কাজ তখন আমাকে পেয়ে বসল। আমার স্বভাব এই যে, যখন কোনো দায় গ্রহণ করি তখন তার মধ্যে নিজেকে নিমগ্ন করে দিই, প্ৰাণপণে কর্তব্য সম্পন্ন করি, ফাকি দিতে পারি নে। এক সময় আমাকে মাস্টারি করতে হয়েছিল, তখন সেই কাজ সমস্ত মন দিয়ে করেছি, তাতে নিমগ্ন হয়েছি এবং তার মধ্যে আনন্দ পেয়েছি। যখন আমি জমিদারির কাজে প্রবৃত্ত তখন তার জটিলতা ভেদ করে। রহস্য উদঘাটন করতে চেষ্টা করেছি। আমি নিজে চিন্তা করে যে-সকল রাস্তা বানিয়েছিলুম তাতে আমি খ্যাতিলাভ করেছিলুম। এমন-কি, পার্শ্ববতী জমিদারেরা আমার কাছে তাদের কর্মচারী পাঠিয়ে দিতেন, কী প্ৰণালীতে আমি কাজ করি তাই জানিবার জন্যে । আমি কোনোদিন পুরাতন বিধি মেনে চলি নি । এতে আমার পুরাতন কর্মচারীরা বিপদে পড়ল। তারা জমিদারির কাগজপত্র এমনভাবে রাখত। যা আমার পক্ষে দুৰ্গম । তারা আমাকে যা বুঝিয়ে দিত তাই বুঝতে হবে, এই তাদের মতলব । তাদের প্রণালী বদলে দিলে কাজের ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এই ছিল তাদের ভয় । তারা আমাকে বলত যে, যখন মামলা হবে তখন আদালতে নতুন ধারার *?াজপত্র গ্রহণ করবে না, সন্দেহের চোখে দেখবে। কিন্তু যেখানে কোনো বাধা সেখানে আমার মন বিদ্ৰোহী হয়ে ওঠে, বাধা আমি মানতে চাই নে। আমি আদ্যোপােন্ত পরিবর্তন করেছিলুম, তাতে ফলও হয়েছিল ভালো । প্ৰজারী আমাকে দর্শন করতে আসত, তাদের জন্য সর্বদাই আমার দ্বার ছিল অবরিত- সন্ধ্যা * রাত্রি হােক, তাদের কোনো মানা ছিল না। এক-এক সময় সমস্তদিন তাদের দরবার নিয়ে দিন