পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি ՀԳֆ ঘাটে অধিক বিলম্ব করিতেছে না। জলের উপরে মেঘবিছুরিত একটা রুদ্র আলোক পড়িয়াছে এবং ক্ষণে ক্ষণে নদীনীর এক তীর হইতে আর-এক তীর পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিতেছে। স্টীমার যথানিয়মে চলিয়াছে। দুর্যোগের নানা অসুবিধার মধ্যে কোনোমতে কমলার রাধাবাড়া চলিতে লাগিল । চক্রবর্তী আকাশের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “মা, ও বেলা যাহাতে রাধিতে না হয় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে । তুমি খিচুড়ি চড়াইয়া দাও, আমি ইতিমধ্যে রুটি গড়িয়া রাখি।” খাওয়া-দাওয়া শেষ হইতে আজ অনেক বেলা হইল। দমকা হাওয়ার জোর ক্ৰমে বাড়িয়া উঠিল। নদী ফেনাইয়া ফেনাইয়া ফুলিতে লাগিল। সূর্য অস্ত গেছে কি না বুঝা গেল না। সকাল-সকাল স্টীমার নোঙর ফেলিল । সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘের মধ্য হইতে বিকারের পাংশুবৰ্ণ হাসির মতো একবার জ্যোৎস্নার আলো বাহির হইতে লাগিল। তুমুলবেগে বাতাস এবং মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। কমলা একবার জলে ডুবিয়াছে— ঝড়ের ঝাপটাকে সে অগ্রাহা করিতে পারে না। রমেশ আসিয়া তাহাকে আশ্বাস দিল, “স্টীমারে কোনো ভয় নাই কমলা। তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতে পাের, আমি দ্বারের কাছে আসিয়া চক্রবর্তী কহিলেন, “মা লক্ষ্মী, ভয় নাই, ঝড়ের বাপের সাধ্য কী তোমাকে স্পর্শ করে ।” ঝড়ের বাপের সাধ্য কতদূর তাহা নিশ্চয় বলা কঠিন, কিন্তু ঝড়ের সাধ্য যে কী তাহা কমলার অগোচর নাই ; সে তাড়াতাড়ি দ্বারের কাছে গিয়া বাগ্রস্বরে কহিল, “খুড়োমশায়, তুমি ঘরে আসিয়া বোসো ।” চক্রবর্তী সসংকোচে কহিলেন, “তোমাদের যে এখন শোবার সময় হইল মা, আমি এখন—” ঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন রমেশ সেখানে নাই ; আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “রমেশবাবু এই ঝড়ে গেলেন কোথায় ? শাক-চুরি তো তীহার অভ্যাস নাই।” “কে ও, খুড়ো নাকি ? এই-যে, আমি পাশের ঘরেই আছি।” পাশের ঘরে চক্রবর্তী উকি মারিয়া দেখিলেন, রমেশ বিছানায় অর্ধশয়ান অবস্থায় আলো জ্বালিয়া বই চক্রবর্তী কহিলেন, “বউমা যে একলা ভয়ে সারা হইলেন । আপনার বই তো ঝড়কে ডরায় না, ওটা এখন রাখিয়া দিলে অন্যায় হয় না। আসুন। এ ঘরে ।” কমলা একটা দুৰ্নিবার আবেগবশে আত্মবিস্মৃত হইয়া তাড়াতাড়ি চক্রবর্তীর হাত দৃঢ়ভাবে চাপিয়া রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “না, না খুড়োমশায় ! না, না।” ঝড়ের কল্লোলে কমলার এ কথা রমেশের কানে গোল না, কিন্তু চক্রবর্তী বিস্মিত হইয়া ফিরিয়া আসিলেন । রমেশ বই রাখিয়া এ ঘরে উঠিয়া আসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “কী চক্রবর্তী-খুড়ো, ব্যাপার কী ? কমলা বুঝি আপনাকে-” কমলা রমেশের মুখের দিকে না চাহিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “না, না, আমি উহাকে কেবল গল্প বলিবার জন্য ডাকিয়াছিলাম।” কিসের প্রতিবাদে যে কমলা না না’ বলিল তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিতে পারিত না । এই না’র অর্থ এই যে, যদি মনে কর আমার ভয় ভাঙাইবার দরকার আছে- না, দরকার নাই। যদি মনে কর আমাকে সঙ্গ দিবার প্রয়োজন- না, প্রয়োজন নাই । পরীক্ষণেই কমলা কহিল, “খুড়োমশায়, রাত হইয়া যাইতেছে, আপনি শুইতে যান। একবার উমেশের খবর লইবেন, সে হয়তো ভয় পাইতেছে।” । । দরজার কােছ হইতে একটা আওয়াজ আসিল, “মা, আমি কাহাকেও ভয় করি না ।” উমেশ মুড়িসুড়ি দিয়া কমলার দ্বারের কাছে বসিয়া আছে। কমলার হৃদয় বিগলিত হইয়া গেল ; সে তাড়াতাড়ি বাহিরে গিয়া কহিল, “হ্যা রে উমেশ, তুই ঝড়-জলে ভিজিতেছিস কেন ? লক্ষ্মীছাড়া