পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

नौकानपूर VSS বাড়িটাকে ভয়ংকর পবিত্র করিয়া তুলিলে— আমার মতো লোকের এখানে পা ফেলিবার জায়গা 戒” আগে হইলে যোগেন্দ্রের বিদ্যুপে হেমনলিনী অত্যন্ত কুষ্ঠিত হইয়া পড়িত— এখন অন্নদাবাবু যোগেন্দ্রের কথায় মাঝে মাঝে রাগ করিয়া উঠেন, কিন্তু হেমনলিনী নলিনাক্ষর সঙ্গে যোগ দিয়া শান্তস্নিগ্ধভাবে হাস্য করে। এখন সে একটি দ্বিধাহীন নিশ্চিন্তু নির্ভর অবলম্বন করিয়াছে— এ সম্বন্ধে লজ্জা করাকেও সে দুর্বলতা বলিয়া জ্ঞান করে। লোকে তাহার এখনকার সমস্ত আচরণকে অদ্ভুত মনে করিয়া পরিহাস করিতেছে তাহা সে জনিত ; কিন্তু নলিনাক্ষের প্রতি তাহার ভক্তি ও বিশ্বাস সমস্ত লোককে আচ্ছন্ন করিয়া উঠিয়াছে- এইজন্য লোকের সম্মুখে সে আর সংকুচিত হইত না। একদিন হেমনলিনী প্ৰাতঃস্নানের পর উপাসনা শেষ করিয়া তাহার সেই নিভৃত ঘরটিতে বাতায়নের সম্মুখে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে, এমন সময় হঠাৎ অন্নদাবাবু নলিনাক্ষকে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। হেমনলিনীর হৃদয় তখন পরিপূর্ণ ছিল। সে তৎক্ষণাৎ ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রথমে নলিনাক্ষকে ও পরে তাহার পিতাকে প্ৰণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিল। নলিনাক্ষ সংকুচিত হইয়া উঠিল। অন্নদাবাবু । কহিলেন, “ব্যস্ত হইবেন না নলিনীবাবু, হেম আপনার কর্তব্য করিয়াছে।” অনাদিন এত সকালে নলিনাক্ষ এখানে আসে না। তাই বিশেষ ঔৎসুক্যের সহিত হেমনলিনী তাহার মুখের দিকে চাহিল। নলিনাক্ষ কহিল, “কাশী হইতে মারি খবর পাওয়া গেল, তাহার শরীর তেমন ভালো নাই ; তাই আজ সন্ধ্যার ট্রেনে কাশীতে যাইব স্থির করিয়াছি। দিনের বেলায় যথাসম্ভব আমার সমস্ত কােজ সারিয়া লইতে হইবে, তাই এখন আপনাদের কাছে বিদায় লইতে আসিয়াছি।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “কী আর বলিব, আপনার মা'র অসুখ,ভগবান করুন। তিনি শীঘ্ৰ সূস্থ হইয়া উঠুন। এই কয়দিনে আমরা আপনার কাছে যে উপকার পাইয়াছি তাহার ঋণ কোনোকালে শোধ করিতে পারিব না ।” 教学 R নলিনাক্ষ কহিল, “নিশ্চয় জানিবেন, আপনাদের কােছ হইতে আমি অনেক উপকার পাইয়াছি। প্রতিবেশীকে যেমন যত্নসাহায্য করিতে হয় তাহা তো করিয়াইছেন- তা ছাড়া যে-সকল গভীর কথা লইয়া এতদিন আমি একলা মনে মনে আলোচনা করিতেছিলাম, আপনাদের শ্রদ্ধার দ্বারা তাহাকে নূতন তেজ দিয়াছেন- আমার ভাবনা ও সাধনা আপনাদের জীবন অবলম্বন করিয়া আমার পক্ষে আরো দ্বিগুণ আশ্রয়স্থল হইয়া উঠিয়াছে। অন্য মানুষের হৃদয়ের সহযোগিতায় সার্থকতালাভ যে কত সহজ হইয়া উঠিতে পারে, তাহা আমি বেশ বুঝিয়েছি।” অন্নদা কহিলেন, “আমি আশ্চর্য এই দেখিলাম, আমাদের একটা-কিছুর বড়েই প্রয়োজন হইয়াছিল, কিন্তু সেটা যে কী আমরা জানিতাম না ; ঠিক এমন সময়েই কোথা হইতে আপনাকে পাইলাম এবং দেখিলাম আপনাকে নহিলে আমাদের চলিত না। আমরা অত্যন্ত কুনো, লোকজনের কাছে যাতায়াত আমাদের বড়ে বেশি নাই; কোনাে সভায় গিয়া বক্তৃতা শুনিবার বাতিক আমাদের একেবারে নাই বলিলেই হয়- যদি বা আমি যাই, কিন্তু হেমকে নড়াইতে পারা বড়ো শক্ত। কিন্তু সেদিন এ কী আশ্চর্য বলুন দেখি— যেমনি যোগেনের কাছে শুনিলাম। আপনি বক্তৃতা করবেন, আমরা দুজনেই কোনো আপত্তি প্ৰকাশ না করিয়া সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম- এমন ঘটনা কখনো ঘটে নাই। এসব কথা মনে রাখিবেন নলিনবাবু। ইহা হইতে বুঝিবেন, আপনাকে আমাদের নিঃসন্দিগ্ধ প্রয়োজন *াই, নাহলে এমনটি ঘটিতে পারিত না । আমরা আপনার দায়স্বরূপ ।” নলিনাক্ষ । আপনারাও এ কথা মনে রাখিবেন, আপনাদের কাছে ছাড়া আর কাহারও কাছে আমি আমার জীবনের গৃঢ়কথা প্রকাশ করি নাই। সত্যকে প্রকাশ করিতে পারাই সত্য সম্বন্ধে চরম শিক্ষা। সেই প্রকাশ করিবার গভীর প্রয়োজন আপনাদের দ্বারাই মিটাইতে পারিয়াছি। অতএব আপনাদিগকে *আমার যে কতখানি প্রয়োজন ছিল সে কথাও আপনারা কখনো ভুলিবেন না। হেমনলিনী কোনো কথা কহে নাই ; বাতায়নের ভিতর দিয়া রৌদ্র আসিয়া মেজের উপরে পড়িয়ছিল, তাহারই দিকে তাকাইয়া সে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। নলিনাক্ষর যখন উঠিবার সময়