পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O)8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বামুন-ঠাকরুন, আমার কাছে যতদিন আছ ঘাটে একলা স্নান করিতে যাওয়া, আত্মীয়ের সন্ধানে শহরে বাহির হওয়া, ও-সমস্ত চলিবে না। তাহা বলিয়া রাখিতেছি। দরোয়নের উপর হুকুম হইয়া গেল, তুলসীকে এই দণ্ডে দূর করিয়া দেওয়া হয়, সে যেন এ বাড়িমুখে হইতে না পারে। । গৃহিণীর শাসনে অন্যান্য চাকরেরা কমলার সংস্রব যথাসম্ভব পরিত্যাগ করিল। নলিনাক্ষ সম্বন্ধে যতদিন কমলা নিশ্চিত ছিল না ততদিন তাহার ধৈর্য ছিল ; এখন তাহার পক্ষে ধৈর্যরক্ষা করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। এই নগরেই তাহার স্বামী রহিয়াছেন। অথচ সে এক মুহুৰ্তও যে অন্যের ঘরে আশ্রয় লইয়া থাকিবে, ইহা তাহার পক্ষে অসহ্য হইল । কাজকর্মে তাহার পদে পদে ক্রটি হইতে লাগিল । নবীনকালী কহিলেন, “বলি বামুন-ঠাকরুন, তোমার গতিক তো ভালো দেখি না। তোমাকে কি ভূতে পাইয়াছে ? তুমি নিজে তো খাওয়াদাওয়া বন্ধ করিয়াছ, আমাদিগকেও কি উপাস করাইয়া মারিবে ? আজকাল তোমার রান্না যে আর মুখে দেবার জো নাই।” কমলা কহিল, “আমি এখানে আর কাজ করিতে পারিতেছি না, আমার কোনোমতে মন টিকিতেছে না । আমাকে বিদায় দিন ।” নবীনকালী ঝংকার দিয়া বলিলেন, “বটেই তো ! কলিকালে কাহারও ভালো করিতে নাই । তোমাকে দয়া করিয়া আশ্রয় দিবার জন্যে আমার এতকালের অমন ভালো বামুনটাকে ছাড়াইয়া দিলাম, একবার খবরও লইলাম না তুমি সত্যি বামুনের মেয়ে কি না। আজ উনি বলেন। কিনা, আমাকে বিদায় দিন। যদি পলাইবার চেষ্টা কর তো পুলিসে খবর দিব না! আমার ছেলে হাকিম— তার হুকুমে কত লোক ফাঁসি গেছে, আমার কাছে তোমার চালাকি খাটিবে না। শুনেইছ তো— গদা কর্তার মুখের উপরে জবাব দিতে গিয়াছিল, সে বেটা এমনি জব্দ হইয়াছে, আজও সে জেল খাটিতেছে। আমাদের তুমি যেমন-তেমন পাও নাই।” কথাটা মিথ্যা নহে— গদা চাকরকে ঘড়িচুরির অপবাদ দিয়া জেলে পাঠানো হইয়াছে বটে। কমলা কোনো উপায় খুঁজিয়া পাইল না। তাহার চিরজীবনের সার্থকতা যখন হাত বাড়াইলেই পাওয়া যায়, তখন সেই হাতে বাধন পড়ার মতো এমন নিষ্ঠুর আর কী হইতে পারে। কমলা আপনার কাজের মধ্যে, ঘরের মধ্যে কিছুতেই আর তো বদ্ধ হইয়া থাকিতে পারে না। তাহার রাত্রের কাজ শেষ হইয়া গেলে পর সে শীতে একখানা র্যাপার মুড়ি দিয়া বাগানে বাহির হইয়া পড়িত। প্রাচীরের ধারে দাড়াইয়া, যে পথ শহরের দিকে চলিয়া গেছে সেই পথের দিকে চাহিয়া থাকিত । তাহার যে তরুণ হৃদয়খনি সেবার জন্য ব্যাকুল, ভক্তিনিবেদনের জন্য ব্যগ্র, সেই হৃদয়কে কমলা এই রজনীর নির্জন পথ বাহিয়া নগরের মধ্যে কোন-এক অপরিচিত গৃহের উদ্দেশে প্রেরণ করিত-তাহার পর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হইয়া দাড়াইয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিয়া তাহার শয়নকক্ষের মধ্যে ফিরিয়া আসিত। কিন্তু এইটুকু সুখ এইটুকু স্বাধীনতাও কমলার বেশি দিন রহিল না। রাত্রির সমস্ত কাজ শেষ হইয়া গেলেও একদিন কী কারণে নবীনকালী কমলাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন । বেহায়া আসিয়া খবর দিল, “বামুন-ঠাকরুনকে দেখিতে পাইলাম না।” নবীনকালী ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “সে কী রে, তবে পালাইল নাকি ?” নবীনকালী নিজে সেই রাত্রে আলো ধরিয়া ঘরে ঘরে খোজ করিয়া আসিলেন, কোথাও কমলাকে দেখিতে পাইলেন না। মুকুন্দবাবু অৰ্ধনমীলিতনেত্রে গুড়গুড়ি টানিতেছিলেন ; তঁহাকে গিয়া কহিলেন, “ওগো, শুনিছ ? বামুন-ঠাকরুন বােধ করি পলাইল।” ইহাতেও মুকুন্দবাবুর শান্তিভঙ্গ করিল না ; তিনি কেবল আলস্যজড়িত কণ্ঠে কহিলেন, “তখনই তো বারণ করিয়াছিলাম ; জানাশোনা লোক নয়। কিছু সরাইয়াছে নকি ?” গৃহিণী কহিলেন, “সেদিন তাহাকে যে শীতের কাপড়খানা পরিতে দিয়াছিলাম, সেটা তো ঘরে নাই, এ ছাড়া আর কী গিয়াছে, এখনো দেখি নাই ।”