পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা । S)SV9 বিনয়। সত্যি বৈকি । মহিম । তার চেয়ে মিছে কথার ঘানি থেকে বিনি পয়সায় যে তেলাটুকু বেরোয় তারই এক-আধ দুটাক তার পায়ে মালিশ করে যদি বলি সাধুজ, বাবা পরমহংস, দয়া করে বুলিটা একটু ঝাড়ো, ওর ধুলা পেলেও বেঁচে যাব তা হলে তােমারই ঘরের মালের অন্তত একটা অংশ হয়তাে তােমারই ঘরে ফিরে আসতে পারে, অথচ শান্তিভঙ্গেরও আশঙ্কা থাকে না। যদি বুঝে দেখ তো একেই বলে পেট্রিয়টিজম। কিন্তু আমার ভায়া চটছে। ও হিন্দু হয়ে অবধি আমাকে দাদা বলে খুব মানে, ওর সামনে আজ আমার কথাগুলো ঠিক বড়োভায়ের মতো হল না। কিন্তু কী করব ভাই, মিছে কথা সম্বন্ধেও তো সত্যি কথাটা বলতে হবে। বিনয়, সেই লেখাটা কিন্তু চাই। রোসো, আমার নোট লেখা আছে, সেটা নিয়ে আসি । বলিয়া মহিম তামাক টানিতে টানিতে বাহির হইয়া গেলেন। গোরা বিনয়কে কহিল, “বিনু, তুমি দাদার ঘরে গিয়ে ওঁকে ঠেকাও গে। আমি লেখাটা শেষ করে ফেলি।” G “ওগো, শুনিছ ? আমি তোমার পুজোর ঘরে ঢুকছি নে, ভয় নেই। আহ্নিক শেষ হলে একবার ও ঘরে যেয়ো— তোমার সঙ্গে কথা আছে। দুজন নূতন সন্ন্যাসী যখন এসেছে তখন কিছুকাল তোমার আর দেখা পাব না জানি, সেইজন্যে বলতে এলুম। ভুলো না, একবার যেয়ো ।” এই বলিয়া আনন্দময়ী ঘরকরনার কাজে ফিরিয়া গেলেন । কৃষ্ণদয়ালবাবু শ্যামবর্ণ দোহারা-গোছের মানুষ, বেশি লম্বা নহেন। মুখের মধ্যে বড়ো বড়ো দুইটা চোখ সব চেয়ে চোখে পড়ে, বাকি প্রায় সমস্তই কঁচাপাকা গোফে দাড়িতে সমাচ্ছন্ন। ইনি সর্বদাই গেরুয়া রঙের পট্টবস্ত্র পরিয়া আছেন, হাতের কাছে পিতলের কমণ্ডলু, পায়ে খড়ম। মাথার সামনের দিকে টাক পড়িয়া আসিতেছে— বাকি বড়ো বড়ো চুল গ্রন্থি দিয়া মাথার উপরে একটা চূড়া করিয়া বাধা । y একদিন পশ্চিমে থাকিতে ইনি পলটনের গোরাদের সঙ্গে মিশিয়া মদ-মাংস খাইয়া একাকার করিয়া দিয়াছেন। তখন দেশের পূজারি পুরোহিত বৈষ্ণব সন্ন্যাসী শ্রেণীর লোকদিগকে গায়ে পড়িয়া অপমান করাকে পৌরুষ বলিয়া জ্ঞান করিতেন, এখন না মানেন এমন জিনিস নাই। নূতন সন্ন্যাসী দেখিলেই তাহার কাছে নূতন সাধনার পন্থী শিখিতে বসিয়া যান। মুক্তির নিগুঢ় পথ এবং যোগের নিগৃঢ় প্রণালীর জন্য ইহার লুব্ধতার অবধি নাই। তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাস করিবেন বলিয়া কৃষ্ণদয়াল কিছুদিন উপদেশ গুছিলেন এমন সময় একজন বৌদ্ধ পুরোহিতের সন্ধান পাইয়া সম্প্রতি র্তাহার মন চঞ্চল হইয়া ইহার প্রথম স্ত্রী একটি পুত্র প্রসব করিয়া যখন মারা যান তখন ইহার বয়স তেইশ বছর। মাতার মৃত্যুর কারণ বলিয়া, রাগ করিয়া ছেলেটিকে র্তাহার শ্বশুরবাড়ি রাখিয়া কৃষ্ণদয়াল প্ৰবল বৈরাগ্যের ঝোকে একেবারে পশ্চিমে চলিয়া যান এবং ছয় মাসের মধ্যেই কাশীবাসী সার্বভৌম মহাশয়ের পিতৃহীনা পৌত্রী আনন্দময়ীকে বিবাহ করেন। পশ্চিমে কৃষ্ণদয়াল চাকরির জোগাড় করিলেন এবং মানবদের কাছে নানা উপায়ে প্রতিপত্তি করিয়া লাইলেন। ইতিমধ্যে সার্বভোমের মৃত্যু হইল ; অন্য কোনো অভিভাবক না থাকাতে স্ত্রীকে নিজের কাছে আনিয়াই রাখিতে হইল । 剥 ইতিমধ্যে যখন সিপাহিদের মুটিনি বাধিল সেই সময়ে কৌশলে দুই-এক জন উচ্চপদস্থ ইংরেজের প্রাণরক্ষা করিয়া ইনি যশ এবং জায়গির লাভ করেন। মুটিনির কিছুকাল পরেই কাজ ছাড়িয়া দিলেন এবং নবজাত গোরাকে লইয়া কিছুদিন কাশীতে কাটাইলেন। গোরার বয়স যখন বছর পাচেক হইল তখন কৃষ্ণদয়াল কলিকাতায় আসিয়া তাহার বড়ো ছেলে মহিমকে তাহার মামার বাড়ি হইতে নিজের কাছে আনাইয়া মানুষ করিলেন। এখন মহিম পিতার মুরুব্বিদের অনুগ্রহে সরকারি খাতাঞ্জিখানায় খুব