পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SO রবীন্দ্র-রচনাবলী বেধে গেল না ? হারান । সত্য কথা বলব না ? গোরা । রাগ করবেন না, কিন্তু এ কথা যদি আপনি যথার্থই সত্য বলে জানতেন তা হলে আমন আরামে অত আস্ফালন করে বলতে পারতেন না। কথাটি মিথ্যে জানেন বলেই আপনার মুখ দিয়ে বেরোল। হারানবাবু, মিথ্যা পাপ, মিথ্যা নিন্দা আরো পাপ, এবং স্বজাতির মিথ্যা নিন্দার মতো পাপ অল্পই আছে । হারান ক্ৰোধে অধীর হইয়া উঠিলেন । গোরা কহিল, “আপনি একলাই কি আপনার সমস্ত স্বজাতির চেয়ে বড়ো ? রাগ আপনি করবেন— আর আমাদের পিতৃপিতামহের হয়ে আমরা সমস্ত সহ্য করব ।” ইহার পর হারানের পক্ষে হার মানা আরো শক্ত হইয়া উঠিল। তিনি আরো সুর চড়াইয়া বাঙালির নিন্দায় প্রবৃত্ত হইলেন। বাঙালি-সমাজের নানাপ্রকার প্রথার উল্লেখে কহিলেন, “এ-সমস্ত থাকতে বাঙালির কোনো আশা নেই ।” গোরা কহিল, “আপনি যাকে কুপ্ৰথা বলছেন সে কেবল ইংরেজি বই মুখস্থ করে বলছেন, নিজে ও সম্বন্ধে কিছুই জানেন না । ইংরেজের সমস্ত কুপ্রথাকেও যখন আপনি ঠিক এমনি করেই অবজ্ঞা করতে পারবেন তখন এ সম্বন্ধে কথা কবেন ।” পরেশ এই প্রসঙ্গ বন্ধ করিয়া দিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ক্রুদ্ধ হারান নিবৃত্ত হইলেন না। সূর্য অন্ত গেল ; মেঘের ভিতর হইতে একটা অপরূপ আরক্ত আভায় সমস্ত আকাশ লাবণ্যময় হইয়া উঠিল ; সমস্ত তর্কের কোলাহল ছাপাইয়া বিনয়ের প্রাণের ভিতরে একটা সুর বাজিতে লাগিল। পরেশ তাহার সায়ংকালীন উপাসনায় মন দিবার জন্য ছাত হইতে উঠিয়া বাগানের প্রান্তে একটা বড়ো চাপাগাছের তলায় বাধানো বেদিতে গিয়া বসিলেন । গোরার প্রতি বরদাসুন্দরীর মন যেমন বিমুখ হইয়াছিল হারানও তেমনি তাহার প্রিয় ছিল না। এই উভয়ের তর্ক যখন তাহার একেবারে অসহ্য হইয়া উঠিল। তিনি বিনয়কে ডাকিয়া কহিলেন, “আসুন বিনয়বাবু, আমরা ঘরে যাই ।” বরদাসুন্দরীর এই সস্নেহ পক্ষপাত স্বীকার করিয়া বিনয়কে ছাত ছাড়িয়া অগত্যা ঘরের মধ্যে যাইতে হইল। বরদা তাহার মেয়েদের ডাকিয়া লইলেন। সতীশ তর্কের গতিক দেখিয়া পূর্বেই চিনাবাদামের কিঞ্চিৎ অংশ সংগ্ৰহ-পূর্বক খুদে কুকুরকে সঙ্গে লইয়া অন্তর্ধন করিয়াছিল। বরদাসুন্দরী বিনয়ের কাছে তাহার মেয়েদের গুণপনার পরিচয় দিতে লাগিলেন। লাবণ্যকে বলিলেন, “তোমার সেই খাতাটা এনে বিনয়বাবুকে দেখাও-না।” বাড়ির নূতন-আলাপীদের এই খাতা দেখানো লাবণ্যর অভ্যাস হইয়াছিল। এমন-কি, সে ইহার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করিয়া থাকিত। আজ তর্ক উঠিয়া পড়াতে সে ক্ষুন্ন হইয়া পড়িয়ছিল। বিনয় খাতা খুলিয়া দেখিল, তাহাতে কবি মুর এবং লংফেলোর ইংরেজি কবিতা লেখা। হাতের মৃত্যুর পরিপটা প্রকাশ পাইতেছে। কবিতাগুলির শিরনাম এবং অবন্ধের অক্ষর রোমন এই লেখাগুলি দেখিয়া বিনয়ের মনে অকৃত্রিম বিস্ময় উৎপন্ন হইল। তখনকার দিনে মুরের কবিতা খাতায় কপি করিতে পারা মেয়েদের পক্ষে কম বাহাদুরি ছিল না। বিনয়ের মন যথোচিত অভিভূত হইয়াছে দেখিয়া বরদাসুন্দরী র্তাহার মেজো মেয়েকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “ললিতা, লক্ষ্মী মেয়ে ললিতা শক্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “নামা, আমি পারব না। সে আমার ভালো মনে নেই।” বলিয়া সে দূরে জানালার কাছে দাড়াইয়া রাস্তা দেখিতে লাগিল। . . . . বরদাসুন্দরী বিনয়কে বুঝাইয়া দিলেন, মনে সমস্তই আছে, কিন্তু ললিতা বড়ো চাপা, বিদ্যা বাহির করিতে চায় না। এই বলিয়া ললিতার আশ্চর্যবিদ্যাবুদ্ধির পরিচয়-স্বরূপ দুই-একটা ঘটনা বিবৃত করিয়া বলিলেন, ললিতা শিশুকাল হইতেই এইরূপ, কান্না পাইলেও মেয়ে চােখের জল ফেলিতে চাহিত না।