পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(s 8V বিনয় । কাকে দিতে বললেন ? সতীশ । আপনাকে । ললিতা রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়া সতীশের পিঠে এক চাপড় মারিয়া কহিল, “তোর মতো বোকা তো আমি দেখি নি। বিনয়বাবুর ছবির বদলে তুই তীকে ফুল দিতে চাইলি নে ?” সতীশ হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, “হী, তাই তো, কিন্তু তুমিই আমাকে দিতে বললে না ?” সতীশের সঙ্গে তকরার করিতে গিয়া ললিতা আরো বেশি করিয়া জালে জড়াইয়া পড়িল। বিনয় স্পষ্ট বুঝিল ফুল দুটি ললিতাই দিয়াছে, কিন্তু বেনমিতেই কাজ করা তাহার অভিপ্ৰায় ছিল। বিনয় কহিল, “আপনার ফুলের দাবি আমি ছেড়েই দিচ্ছি, কিন্তু তাই বলে আমার এই ফুলের মধ্যে ভুল কিছুই নেই। আমাদের বিবাদনিম্পত্তির শুভ উপলক্ষে এই ফুল কয়টি—” ললিতা মাথা নাডিয়া কহিল, “আমাদের বিবাদই বা কী, আর তার নিম্পত্তিই বা কিসের ?” বিনয় কহিল, “একেবারে আগাগোড়া সমস্তই মায়া ? বিবাদও ভুল, ফুলও তাই, নিম্পত্তিও মিথ্যা ? শুধু শক্তিতে রাজতন্ত্রম নয়, শুক্তিটা সুদ্ধই ভ্ৰম ? ঐ-যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে অভিনয়ের একটা কথা হচ্ছিল সেটা-” ললিত কহিল, “সেটা ভ্ৰম নয়। কিন্তু তা নিয়ে ঝগড়া কিসের ? আপনি কেন মনে করছেন আপনাকে এইটােতে রাজি করবার জন্যে আমি মস্ত একটা লড়াই বাঁধিয়ে দিয়েছি, আপনি সম্মত হওয়াতেই আমি কৃতাৰ্থ হয়েছি! আপনার কাছে অভিনয় করাটা যদি অন্যায় বোধ হয়। কারও কথা শুনে কেনই বা তাতে রাজি হবেন ?” এই বলিয়া ললিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সমস্তই উলটা ব্যাপার হইল। আজ ললিতা ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল যে, সে বিনয়ের কাছে নিজের হার স্বীকার করিবে এবং যাহাতে অভিনয়ে বিনয় যোগ না দেয় তাহাকে সেই অনুরোধ করিবে । কিন্তু এমন করিয়া কথাটা উঠিল এবং এমন ভাবে তাহার পরিণতি হইল যে, ফল ঠিক উলটা দাড়াইল । বিনয় মনে করিল, সে যে অভিনয় সম্বন্ধে এতদিন বিরুদ্ধতা প্ৰকাশ করিয়াছিল তাঁহারই প্ৰতিঘাতের উত্তেজনা এখনো ললিতার মনে রহিয়া গেছে। বিনয় যে কেবল বাহিরে হার মানিয়াছে, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার বিরোধ রহিয়াছে, এইজন্য ললিতার ক্ষোভ দূর হইতেছে না। ললিতা এই ব্যাপারটাতে যে এতটা আঘাত পাইয়াছে ইহাতে বিনয় ব্যথিত হইয়া উঠিল। সে মনে মনে স্থির করিল, এই কথাটা লইয়া সে আর কোনো আলোচনা উপহাসচ্ছলেও করিবে না এবং এমন নিষ্ঠা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে এই কাজটাকে সম্পন্ন করিয়া তুলিবে যে কেহ তাহার প্রতি ঔদাসীন্যের অপরাধ আরোপ করিতে পরিবে না । সুচরিতা আজ প্ৰাতঃকাল হইতে নিজের শোবার ঘরে নিভৃতে বসিয়া ‘খুস্টের অনুকরণ’ নামক একটি ইংরেজি ধর্মগ্রন্থ পড়িবার চেষ্টা করিতেছে। আজ সে তাহার অন্যান্য নিয়মিত কর্মে যোগ দেয় নাই। মাঝে মাঝে গ্রন্থ হইতে মন ভ্ৰষ্ট হইয়া পড়াতে বইয়ের লেখাগুলি তাহার কাছে ছায়া হইয়া পড়িতেছিল— আবার পরীক্ষণে নিজের উপর রাগ করিয়া বিশেষ বেগের সহিত চিত্তকে গ্রন্থের মধ্যে আবদ্ধ করিতেছিল, কোনোমতেই হার মানিতে চাহিতেছিল না । এক সময় দূর হইতে কণ্ঠস্বর শুনিয়া মনে হইল, বিনয়বাবু আসিয়াছেন ; তখনই চমকিয়া উঠিয়াবই রাখিয়া বাহিরের ঘরে যাইবার জন্য মন ব্যস্ত হইয়া উঠিল। নিজের এই ব্যস্ততাতে নিজের উপর ক্রুদ্ধ হইয়া সুচরিতা আবার চৌকির উপর বসিয়া বই লইয়া পড়িল। পাছে কানে শব্দ যায় বলিয়া দুই কান চাপিয়া পড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিল । এমন সময় ললিতা তাহার ঘরে আসিল । সুচরিতা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “তোর কী হয়েছে বল তো।” ললিতা তীব্ৰ ভাবে ঘােড় নাড়িয়া কহিল, “কিছু না ।” সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় ছিলি ?” ললিতা কহিল, “বিনয়বাবু এসেছেন, তিনি বোধ হয় তোমার সঙ্গে গল্প করতে চান।”