পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা । 8S বিনয় পরদিন পুস্তিকা ও কাগজের এক পুঁটুলি আনিয়া সুচরিতাকে দিয়া গেল। সুচরিতা সেগুলি হাতে পাইয়া আর পড়িল না, বাক্সের মধ্যে রাখিয়া দিল। পড়িতে অত্যন্ত ইচ্ছা করিল বলিয়াই পড়িল না। চিত্তকে কোনােমতেই বিক্ষিপ্ত হইতে দিবে না প্রতিজ্ঞা করিয়া নিজের বিদ্রোহী চিত্তকে পুনর্বার হারানবাবুর শাসনাধীনে সমর্পণ করিয়া আর-একবার সে সান্তনা অনুভব করিল। QC রবিবার দিন সকালে আনন্দময়ী পান সাজিতেছিলেন, শশিমুখী তাহারপাশে বসিয়া সুপারি। কাটিয়া স্তুপাকার করিতেছিল। এমন সময় বিনয় আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিতেই শশিমুখী তাহার কোলের আঁচল হইতে সুপারি ফেলিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া গেল। আনন্দময়ী একটুখানি মুচুকিয়া হাসিলেন। বিনয় সকলেরই সঙ্গে ভােব করিতে পারিত। শশিমুখীর সঙ্গে এতদিন তাহার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। উভয় পক্ষেই পরস্পরের প্রতি খুব উপদ্রব চলিত। শশিমুখী বিনয়ের জুতা লুকাইয়া রাখিয়া তাহার নিকট হইতে গল্প আদায় করিবার উপায় বাহির করিয়াছিল। বিনয় শশিমুখীর জীবনের দুই-একটা সামান্য ঘটনা অবলম্বন করিয়া তাহাতে যথেষ্ট রঙ ফলাইয়া দুই-একটা গল্প বানাইয়া রাখিয়াছিল। তাহারই অবতারণা করিলে শশিমুখী বড়োই জব্দ হইত। প্রথমে সে বক্তার প্রতি মিথ্যা ভাষণের - অপবাদ দিয়া উচ্চকণ্ঠে প্ৰতিবাদের চেষ্টা করিত ; তাহাতে হার মানিলে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিত। সেও বিনয়ের জীবনচরিত বিকৃত করিয়া পালটা গল্প বানাইবার চেষ্টা করিয়াছে— কিন্তু রচনাশক্তিতে সে বিনয়ের সমকক্ষ না হওয়াতে এ সম্বন্ধে বড়ো একটা সফলতা লাভ করিতে পারে নাই। যাহা হউক, বিনয় এ বাড়িতে আসিলেই সব কাজ ফেলিয়া শশিমুখী তাহার সঙ্গে গোলমাল করিবার জন্য ছুটিয়া আসিত । এক-এক দিন এত উৎপাত করিত যে আনন্দময়ী তাহাকে ভৎসনা করিতেন, কিন্তু দোষ তো তাহার একলার ছিল না, বিনয় তাহাকে এমনি উত্তেজিত করিয়া তুলিত যে আত্মসংবরণ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইত। সেই শশিমুখী আজ যখন বিনয়কে দেখিয়া তাড়াতাড়ি ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া গেল তখন আনন্দময়ী হাসিলেন, কিন্তু সে হাসি সুখের হাসি নহে। বিনয়কেও এই ক্ষুদ্র ঘটনায় এমন আঘাত করিল যে, সে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনয়ের পক্ষে শশিমুখীকে বিবাহ করা যে কতখানি অসংগত তাহা এইরূপ ছোটােখাটাে ব্যাপারেই ফুটিয়া উঠে। বিনয় যখন সম্মতি দিয়াছিল তখন সে কেবল গোরার সঙ্গে তাহার বন্ধুত্বের কথাই চিন্তা করিয়াছিল, ব্যাপারটাকে কল্পনার দ্বারা অনুভব করে নাই। তা ছাড়া আমাদের দেশে । বিবাহটা যে প্রধানত ব্যক্তিগত নহে, তাহা পারিবারিক, এই কথা লইয়া বিনয় গৌরব করিয়া কাগজে অনেক প্ৰবন্ধ লিখিয়ছে ; নিজেও এই সম্বন্ধে কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা বিতৃষ্ণকে মনে স্থানও দেয় নাই। আজ শশিমুখী যে বিনয়কে দেখিয়া আপনার বর বলিয়া জিব কাটিয়া পলাইয়া গেল ইহাতে শশিমুখীর সঙ্গে তাহার ভাবী সম্বন্ধের একটা চেহারা তাহার কাছে দেখা দিল। মুহুর্তের মধ্যে তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। গোরা যে তাহার প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাহাকে কতদূর পর্যন্ত লইয়া যাইতেছিল। ইহা মনে করিয়া গোরার উপরে তাহার রাগ হইল, নিজের উপরে ধিক্কার জম্মিল, এবং আনন্দময়ী যে প্রথম হইতেই এই বিবাহে নিষেধ করিয়াছেন তাহা স্মরণ করিয়া তাহার সূক্ষ্মদৰ্শিতায় তাহার প্রতি বিনয়ের মন বিস্ময়মিশ্ৰিত ভক্তিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল। আনন্দময়ী বিনয়ের মনের ভাবটা বুঝিলেন। তিনি অন্য দিকে তাহার মনকে ফিরাইবার জন্য বলিলেন, “কাল গোরার চিঠি পেয়েছি বিনয় ।” বিনয় একটু অন্যমনস্ক ভাবেই কহিল, “কী লিখেছে ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “নিজের খবর বড়ো একটা কিছু দেয় নি। দেশের ছোটােলোকদের দুৰ্দশা দেখে দুঃখ করে লিখেছে। ঘোষপাড়া বলে কোন এক গ্রামে ম্যাজিষ্ট্রেট কী সব অন্যায়