পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७१९ i রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রার্থনা সকলেই জানেন একটা গল্প আছে—দেবতা একজনকে তিনটে বর দিতে চাহিয়াছিলেন। এত বড়ো সুযোগটাতে হতভাগ্য কী যে চাহিবে, ভাবিয়া বিহবল হইল— শেষকালে উদভ্ৰাস্তচিত্তে যে-তিনটে প্রার্থনা জানাইল, তাহা এমনি অকিঞ্চিৎকর যে, তাহার পরে চিরজীবন অমুতাপ করিয়া তাহার দিন কাটিল । এই গল্পের তাৎপর্য এই যে, আমরা মনে করি পৃথিবীতে আর কিছু জানি বা না-জানি, ইচ্ছাটাই বুঝি আমাদের কাছে সব-চেয়ে জাজল্যমান—আমি সব-চেয়ে কী চাই, তাহাই বুঝি সব-চেয়ে আমার কাছে সুস্পষ্ট—কিন্তু সেটা ভ্রম ; আমার যথার্থ ইচ্ছা আমার অগোচর । অগোচরে থাকিবার একটা কারণ আছে—সেই ইচ্ছাই আমাকে নানা অমুকুল ও প্রতিকুল অবস্থার ভিতর দিয়া গড়িয়া তুলিবার ভার লইয়াছে। যে বিরাট ইচ্ছা সমস্ত মানুষকে মানুষ করিয়া তুলিতে উদযোগী, সেই ইচ্ছাই আমার অস্তরে থাকিয় কাজ করিতেছে। ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ইচ্ছা লুকাইয়া কাজ করে,—যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনাকে সর্বাংশে তাহার অনুকুল করিয়া তুলিতে না পারি। তাহার উপরে হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার আমরা লাভ করি নাই বলিয়াই সে আমাদিগকে ধরা দেয় না । আমার সব-চয়ে সত্য ইচ্ছা নিত্য ইচ্ছা কোনটা? যে-ইচ্ছা আমার সার্থকতাসাধনে নিরত। আমার সার্থকতা আমার কাছে যতদিন পর্যস্ত রহস্ত, সেই ইচ্ছাও ততদিন আমার কাছে গুপ্ত। কিসে আমার পেট ভরিবে, আমার নাম হইবে, তাহ বলা শক্ত নয়—কিন্তু কিসে আমি সম্পূর্ণ হইব, তাহ পৃথিবীতে কয়জন লোক আবিষ্কার করিতে পারিয়াছে ? আমি কী, আমার মধ্যে যে-একটা প্রকাশচেষ্টা চলিতেছে তাহার পরিণাম কী, তাহার গতি কোন দিকে, তাহ স্পষ্ট করিয়া কে জানে ? অতএব দেবতা যদি বর দিতে আসেন, তবে হঠাৎ দেখি, প্রার্থনা জানাইবার জন্তও প্রস্তুত নই। তখন এই কথা বলিতে হয়, আমার যথার্থ প্রার্থনা কী, তাহ জানিবার জন্য আমাকে সুদীর্ঘ সময় দাও । নহিলে উপস্থিতমতো হঠাৎ একটা-কিছু চাহিতে গিয়া হয়তো ভয়ানক ফাকিতে পড়িতে হইবে । বস্তুত আমরা সেই সময় লইয়াছি—আমাদের জীবনটা এই কাজেই আছে। আমরা কী প্রার্থনা করিব, তাহাই অহরহ পরখ করিতেছি। আজ বলিতেছি খেলা, কাল বলিতেছি ধন, পরদিন বলিতেছি মান—এমনি করিয়া সংসারকে অবিশ্রাম মন্থন করিতেছি,—আলোড়ন করিতেছি। কিসের জন্ত ? আমি যথার্থ কী চাই, তাহারই