পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

• বিশ্বাপরিচয় ፴9ዓ শেষোক্ত নীহারিকা, তাতে যত নক্ষত্র জমা হয়েছে, বহু কোটি তার সংখ্যা, অদ্ভুত দ্রুত তাদের গতি । এই যে নক্ষত্রের ভিড় নীহারিকামণ্ডলে অতি দ্রুতবেগে ছুটছে, এরা পরস্পর ধাক্কা লেগে চুরমার হয়ে যায় না কেন। উত্তর দিতে গিয়ে চৈতন্য হল,এই নক্ষত্রপুজকে ভিড় বলা ভুল হয়েছে। এদের মধ্যে গলাগলি ঘেঁষাৰ্ঘেষি একেবারেই নেই। পরস্পরের কাছ থেকে অত্যন্তই দূরে দূরে এরা চলাফেরা করছে। পরমাণুর অন্তর্গত ইলেকট্রনদের গতিপথের দূরত্ব সম্বন্ধে স্যর জেমস জীনস যে উপমা দিয়েছেন এই নক্ষত্রমণ্ডলীর সম্বন্ধেও অনুরূপ উপমাই তিনি প্রয়ােগ করেছেন। লন্ডনে ওয়াটালুনামে এক মন্ত স্টেশন আছে। যতদূর মনে পড়ে সেটা হাওড়া স্টেশনের চেয়ে বড়োই। স্যার জেমস জীনস বলেন সেই স্টেশন থেকে আর-সব খালি করে ফেলে কেবল ছটি মাত্র ধুলোর কণা যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তবে আকাশে নক্ষত্রদের পরস্পর দূরত্ব এই ধূলিকণাদের বিচ্ছেদের সঙ্গে কিছু পরিমাণে তুলনীয় হতে পারবে। তিনি বলেন, নক্ষত্রের সংখ্যা ও আয়তন যতই হােক আকাশের অচিন্তনীয় শূন্যতার সঙ্গে তার তুলনাই হতে পারে না। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, সৃষ্টিতে রূপবৈচিত্র্যের পালা আরম্ভ হবার অনেক আগে কেবল ছিল একটা পরিব্যাপ্ত জ্বলন্ত বাষ্প । গরম জিনিস মাত্রেরই ধর্ম এই যে ক্রমে ক্রমে সে তাপ ছড়াতে থাকে । ফুটন্ত জল প্ৰথমে বাষ্প হয়ে বেরিয়ে আসে। ঠাণ্ডা হতে হতে সেই বাষ্প জমে হয় জলের কণা। অত্যন্ত তাপ দিলে কঠিন পদার্থও ক্রমে যায় গ্যাস হয়ে ; সেইরকম তাপের অবস্থায় বিশ্বেৱ হালকা ভারী সব জিনিসই ছিল গ্যাস। কোটি কোটি বছর ধরে কালে কালে তা ঠাণ্ডা হচ্ছে। তাপ কমতে কমতে গ্যাস থেকে ছোটাে ছোটাে টুকরো ঘন হয়ে ভেঙে পড়েছে। এই বিপুলসংখ্যক কণা তারার আকারে জোট বেঁধে নীহারিকা গড়ে তুলছে। য়ুরোপীয় ভাষায় এদের বলে নেবুলা, বহুবচনে নেবুলী। আমাদের সূৰ্য আছে এইরকম একটি নীহারিকার অন্তর্গত হয়ে । আমেরিকার পর্বতচূড়ায় বসানো হয়েছে মন্ত বড়ো এক দূরবীন, তার ভিতর দিয়ে খুব বড়ো এক নীহারিকা দেখা গেছে। সে আছে অ্যাড্রোমিডা-নামধারী নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে। ঐ নীহারিকার আকার অনেকটা গাড়ির চাকার মতো। সেই চাকা ঘুরছে। এক পাক ঘোরা শেষ করতে তার লাগে প্রায় দু কোটি বছর। নয় লাখ বছর লাগে, এর কাছ থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে । আমাদের সব চেয়ে কাছের যে তারা, যাকে আমাদের তারা-পাড়ার পড়শী বললে চলে, সংখ্যা সাজিয়ে তার দূরত্ব বোঝাবার চেষ্টা করা বৃথা । সংখ্যাবাধা যো-পরিমাণ দূরত্ব মোটামুটি আমাদের পক্ষে বোঝা সহজ, তার সীমা পৃথিবীর গোলকটির মধ্যেই বন্ধ, যাকে আমরা রেলগাড়ি দিয়ে মোটর দিয়ে স্টীমার দিয়ে চলতে চলতে মেপে যাই। পৃথিবী ছাড়িয়ে নক্ষত্র-বস্তির সীমানা মাড়ালেই সংখ্যার ভাষাটাকে প্ৰলাপ বলে মনে হয় । গণিতশাস্ত্ৰ নাক্ষত্রিক হিসাবটার উপর দিয়ে সংখ্যার যে-ডিম পেড়ে চলে সে যেন পৃথিবীর বহুপ্ৰসূ কীটেরই নকলে। সাধারণত আমরা দূরত্ব গনি মাইল বা ক্রোশ হিসাবে, নক্ষত্রদের সম্বন্ধে তা করতে গেলে অঙ্কের বোঝা দুৰ্বহ হয়ে উঠবে। সূৰ্যই তো আমাদের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে, তার চেয়ে বহু লক্ষ গুণ দূরে আছে নক্ষত্রের দল, সংখ্যা দিয়ে তাদের দূরত্ব গোনা কড়ি দিয়ে হাজার হাজার মোহর গোনার মতো। সংখ্যা-সংকেত বানিয়ে মানুষ লেখনের বােঝা হালকা করেছে, হাজার লিখতে তাকে হাজারটা দাড়ি কাটতে হয় না । কিন্তু জ্যোতিষ্কলোকের মাপ। এ সংকেতে কুলোল না । তাই আর-এক সংকেত বেরিয়েছে । তাকে বলা যায় আলো-চলার মাপ।। ৩৬৬ দিনের বছর হিসাবে সে চলে পাঁচ লক্ষ আটাশি হাজার কোটি মাইল। সূর্যপ্ৰদক্ষিণের যেমন সৌর বছর তিনশো পঁয়বটি দিনের পরিমাপে, তেমনি নক্ষত্রদের গতিবিধি, তাদের সীমা-সরহদের মাপ, আলো-চলা বছরের মাত্রা গণনা করে । আমাদের নক্ষত্ৰজগতের ব্যাস আন্দাজ একলক্ষ আলো-বছরের মাপে । আরো অনেক লক্ষ পাকত্রজগৎ আছে। এর বাইরে । সেই সব ভিন্ন গায়ের নক্ষত্রদের মধ্যে একটির পরিচয় ফোটোগ্রাফে ধরা হয়েছে, হিসেব মতে সে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ আলো-বছর দূরে । আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী শিক্ষত্রের দূরত্ব পঁচিশ লক্ষ কোটি মাইল। এর থেকে বোঝা যাবে কী বিপুল শূন্যতার মধ্যে বিশ্ব