পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ &O রবীন্দ্র-রচনাবলী । পাওয়া আপাতত অসম্ভব। তবু এ কথা মানতে মন চায় না, যে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে এই জীবনধারণযোগ চৈতন্যপ্রকাশক অবস্থা একমাত্র এই পৃথিবীতেই ঘটেছে, যে, এই হিসাবে পৃথিবী সমস্ত জগৎধারার একমাত্র ব্যতিক্রম । উপসংহার একদা জগতের সকলের চেয়ে মহাশ্চর্য বার্তা বহন করে বহুকোটি বৎসর পূর্বে তরুণ পৃথিবীতে দেখা দিল আমাদের চক্ষুর অদৃশ্য একটি জীবকোষের কণা। কী মহিমার ইতিহাস সে এনেছিল কত গোপনে। দেহে দেহে অপরাপ শিল্পসম্পদশালী তার সৃষ্টিকার্য নব নব পরীক্ষার ভিতর দিয়ে অনবরত চলে আসছে। যোজনা করবার, শোধন করবার,অতি জটিল কর্মতন্ত্ৰ উদভাবন ও চালনা করবার বুদ্ধি প্রচ্ছন্নভাবে তাদের মধ্যে কোথায় আছে, কেমন করে তাদের ভিতর দিয়ে নিজেকে সক্রিয় করছে, উত্তরোত্তর অভিজ্ঞতা জমিয়ে তুলছে ভেবে তার কিনারা পাওয়া যায় না। অতি পেলাববেদনশীল জীবকোষগুলি বংশাবলীক্ৰমে যথাযথ পথে সমষ্টি বাঁধছে জীবদেহে, নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ; নিজের ভিতরকার উদ্যমে জানি না। কী করে দেহক্রিয়ার এমন আশ্চৰ্য্য কর্তব্যবিভাগ করছে। যে কোষ পাকযন্ত্রের, তার কাজ এক রকমের, যে কোষ মস্তিষ্কের, তার কাজ একেবারেই অন্য রকমের । অথচ জীবাণুকোষগুলি মূলে একই। এদের দুরূহ কাজের ভাগ-বাটােয়ারা হল কোন হুকুমে এবং এদের বিচিত্র কাজের মিলন ঘটিয়ে স্বাস্থ্য নামে একটা সামঞ্জস্য সাধন করল। কিসে। জীবাণুকোষের দুটি প্রধান ক্রিয়া আছে, বাইরে থেকে খাবার জুগিয়ে বঁচা ও বাড়তে থাকা, আর নিজের অনুরূপ জীবনকে উৎপন্ন করে বংশধারা চালিয়ে যাওয়া । এই আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষার জটিল প্ৰয়াস গোড়াতেই এদের উপর ভর করল কোথা থেকে, । অপ্ৰাণ বিশ্বে যে-সব ঘটনা ঘটছে তার পিছনে আছে সমগ্ৰ জড় জগতের ভূমিকা। মন এই সব ঘটনা জানছে, এই জানার পিছনে মনের একটা বিশ্বভূমিকা কোথায়। পাথর লোহা গ্যাসের নিজের মধ্যে তো জানার সম্পর্ক নেই। এই দুঃসাধ্য প্রশ্ন নিয়ে বিশেষ একটা যুগে প্ৰাণ মন এল পৃথিবীতেঅতিক্ষুদ্র জীবকোষকে বাহন করে। পৃথিবীর সৃষ্টি-ইতিহাসে এদের আবির্ভাব অভাবনীয়। কিন্তু সকল কিছুর সঙ্গে সম্বন্ধহীন একান্ত আকস্মিক কোনো অদ্ভুৎপাতকে আমাদের বুদ্ধি মানতে চায় না। আমরা জড়বিশ্বের সঙ্গে মনোবিশ্বের মূলগত ঐক্য কল্পনা করতে পারি সর্বব্যাপী তেজ বা জ্যোতিঃ-পদার্থের মধ্যে। অনেক কাল পরে বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে আপাতদৃষ্টিতে যে সকল স্কুল পদার্থ জ্যোতিহীন, তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন-আকারে নিত্যই জ্যোতির ক্রিয়া চলছে। এই মহাজ্যোতিরই সূক্ষ্ম বিকাশ প্ৰাণে এবং আরো সূক্ষ্মতর বিকাশ চৈতন্যে ও মনে । বিশ্বসৃষ্টির আদিতে মহাজ্যোতি ছাড়া আর কিছুই যখন পাওয়া যায় না, তখন বলা যেতে পারে চৈতন্যে তারই প্রকাশ। জড় থেকে জীবে একে একে পর্দা উঠে মানুষের মধ্যে এই মহাচৈতন্যের আবরণ ঘোচাবার সাধনা চলেছে। চৈতন্যের এই মুক্তির অভিব্যক্তিই বোধ করি সৃষ্টির শেষ পরিণাম। পণ্ডিতেরা বলেন, বিশ্বজগতের আয়ু ক্ৰমাগতই ক্ষয় হচ্ছে। এ কথা চাপা দিয়ে রাখা চলে না । মানুষের দেহের মতোই তাপ নিয়ে জগতের দেহের শক্তি । তাপের ধর্মই হচ্ছে যে, খরচ হতে হতে ক্রমশই নেমে যায় তার উন্মা। সূর্যের উপরিতলের স্তরে যে, তাপশক্তি আছে তার মাত্রা হচ্ছে শূন্য ডিগ্রির পরে ছয় হাজার সেন্টিগ্ৰেড। তারই কিছু কিছু অংশ নিয়ে পৃথিবীতে বাতাস চলছে, জল পড়ছে, প্ৰাণের উদ্যমে জীবজন্তু চলাফেরা করছে। সঞ্চয় তো ফুরোচ্ছে, একদিন তাপের শক্তি মহাশূন্যে ব্যাপ্ত হয়ে গেলে,আবার তাকে টেনে নিয়ে এনে রূপ দেবার যোগ্য করবে। কে । একদিন