পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

goo রবীন্দ্র-রচনাবলী যে প্রাচীন প্রাকৃতের সঙ্গে বাংলা প্রাকৃতের নিকটসম্বন্ধ তার রঙ্গভূমিতে আমাদের স্বরবর্ণগুলি জন্মান্তরে কী রকম লীলা করে এসেছে তার অনুসরণ করে এলে অপভ্রংশের কতকগুলি বাধা রীতি হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে পথের পথিক আমি নই। খবর নিতে হলে যেতে হবে। সুনীতিকুমারের ঘারে। কিন্তু এ সম্বন্ধে রসনার প্রকৃতিগত কোনো সাধারণ নিয়ম বের করা কঠিন হবে। কেননা দেখা যাচ্ছে, পূর্ব উত্তরবঙ্গে এবং দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গে অনেক স্থলে কেবল যে উচ্চারণের পার্থক্য আছে তা ना, पीडN9 लकिठ श् । বাংলাভাষায় স্বরবর্ণের উচ্চারণবিকার নিয়ে আরো কিছু আলোচনা করেছি। আমার বাংলা শব্দতত্বে ।* স্বরবর্ণ সম্বন্ধে পালা শেষ করার পূর্বে একটা কথা বলে নিই। এর পরে প্রত্যয় সম্বন্ধে যেখানে বিস্তারিত করে বলেছি সেখানটা পড়লে পাঠকরা জানতে পারবেন বাংলাভাষাটা ভঙ্গিওয়ালা ভাষা। বাংলায় এ ও উ এই তিনটে স্বরবর্ণ কেবল যে অর্থবান শব্দের বানানের কাজে লাগে তা নয়। সেই শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিছু ভঙ্গি তৈরি করে। "হরিকে যখন হিরে বলি কিংবা ‘কালীকে বলি “কেলো, তখন সেটা সম্মানের সম্ভাষণ বলে শোনাবে না। কিন্তু “হরু' বা ‘কালু, “ভুলু বা ‘খুকু, এমনকি “খাদু শব্দে স্নেহ বহন করে। পূর্বে দেখানো হয়েছে বাংলাই এবং উ স্বরটা সম্মানী, এ এবং ও অন্ত্যজ। আ স্বরটা অনাদৃত, ওর ব্যবহার আছে। অনাদরে, যেমন : মাখন=মাখনা, মদন=মদন, বামন=বামনা। ইংরেজি ‘রবর্ট থেকে বাটি’, ‘এলিজাবেথ থেকে ‘লিজি’, ‘মাৰ্গারেট থেকে মাগি, “উইলিয়ম থেকে উইলি', 'চার্লস থেকে চালি-ইকার স্বরে দেয় আত্মীয়তার টান। ইকারে আদর প্রকাশ বাংলাতেও পাওয়া যায়। সেখানে আকারকে ঠেলে দিয়ে ই এসে বসে, যেমন ; লতা= লতি, কণা=কনি, ক্ষমা=ক্ষেমি, সরলা=সরলি, মীরা=মীরি। অকারান্ত শব্দেও এ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেমন : স্বর্ণ=স্বনি। এগুলি সব মেয়ের নাম। আই যোগেও আদরের সুরলাগে, যেমন : নিমাই নিতাই কানাই বলাই। এ কিংবা ও স্বরের অবজ্ঞা, উ স্বরের স্নেহব্যঞ্জনা সংস্কৃতে পাই নে। বাংলা বর্ণমালায় কতকগুলো বর্ণ আছে যারা বেকার, আর কতকগুলো আছে যারা রেগার খাটে অর্থাৎ নিজের কর্তব্য ছেড়ে অন্যের কাজে লাগে। কি বর্গের অনুনাসিক ও সাধু ভাষায় যুক্তবর্ণে ছাড়া অন্যত্র আপনি গীেরবে স্থান পায় নি। যেখানে রসনায় তার উচ্চারণকে স্বীকার করেছে। সেখানে লেখায় উপেক্ষা করেছে তার স্বরূপকে । ‘রক্তবর্ণ বলতে বোঝায় যে শব্দ তাকে লেখা হয়েছে ‘রাঙ্গা, অর্থাৎ তখনকার ভদ্রলোকেরা ভুল বানান করতে রাজি ছিলেন, কিন্তু ঙর বৈধ দাবি কিছুতে মানতে চাননি। বানান-জগতে আমিই বোধ হয় সাবপ্রথমে ঙার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেম, সেও বোধ করি ছন্দের প্রতি মমতাবশত। যেখানে "ভাঙ্গ” বানান ছন্দকে ভাঙে সেখানে ভাঙন রক্ষা করবার জন্যে ঙর শরণ নিয়ে লিখেছি "ভাঙা । কিন্তু চ বর্গের এgর যথোচিত সদগতি করা যায় নি । এই এঃ অন্য ব্যঞ্জনবর্ণকে আঁকড়িয়ে টিকে থাকে, একক নিজের জোরে কোথাও ঠাই পায় না। ঐ ‘ঠাই কথাটা মনে করিয়ে দিলে যে, এক কালে এণ্ড ছিল ঐ শব্দটার অবলম্বন । প্রাচীন সাহিত্যে অনেক শব্দ পাওয়া যায় অন্তিমে যার এgই ছিল আশ্রয়, যেমন : নাঞি মুঞি খাঞিা হঞা । এইজাতীয় অসমাপিকা ক্রিয়া মাত্রেই এক্কার প্রভুত্ব ছিল । আমার বিশ্বাস, এটা রাঢ়দেশের লেখক ও লিপিকরদের অভ্যন্ত ব্যবহার। অনুনাসিক বর্জনের জন্যেই পূর্ববঙ্গ বিখ্যাত । বাংলা বর্ণমালায় আর-একটা বিভীষিকা আছে, মূর্ধণ্য এবং দন্ত্য ন’এ ভেদাভেদ-তত্ত্ব। বানানে ওদের ভেদ, ব্যবহারে ওরা অভিন্ন। মূর্ধন্য ণ এর আসল উচ্চারণ বাঙালির জানা নেই। কেউ কেউ বলেন, ওটা মূলত দ্রাবিড়ি। ওড়িয়া ভাষায় এর প্রভাব দেখা যায়। ড়ে এ চন্দ্ৰবিন্দুর মতো। ওর উচ্চারণ। খাড়া টাঁড়াল ভাড়ার প্রভৃতি শব্দে ওর পরিচয় পাওয়া যায়। ১ শব্দতত্ত্ব : রবীন্দ্র-রচনাবলী। স্বাদশ খণ্ড (সুলভ ৬) ।