পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় 98) ডাক কোনো-একটা উতলা হাওয়ায় যাহাতে ঘরের মধ্যে আসিয়া পৌঁছিতে না পারে, সেইজন্য কৃত্রিম প্রাচীরগুলাকে যত সমুচ্চ করা সম্ভব সেই চেষ্টাই কেবল চলিতেছে। কিন্তু, এই সমুদ্র ও ডাঙার স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ স্বীকার করিয়া, তাহার বিরোধ ঘুচাইবার দিন আসিয়াছে বলিয়া মনে করি। এই দুয়ে মিলিয়াই মানুষের পৃথিবী । এই দুয়ের মধ্যে বিচ্ছেদকে জাগাইয়া রাখিলেই,মানুষের যতী-কিছু বিপদ। তবে এতদিন এই বিচ্ছেদ চলিয়া আসিতেছে কেন । সে কেবল ইহারা হরগীেরীর মতো তপস্যার দ্বারা পরস্পরকে পাইবে বলিয়াই। ঐ-যে এক দিকে স্থাণু দিগম্বরবেশে সমাধিস্থ হইয়া বসিয়া আছেন, আর-এক দিকে গীেরী নব নব বসন্তপূপে আপনাকে সাজাইয়া তুলিতেছেন- স্বর্গের দেবতারা ইহাদেরই শুভযোগের অপেক্ষা করিয়া আছেন, নহিলে কোনো মঙ্গল-পরিণাম জন্মলাভ করিবে না । আমরা ডাঙার লোকেরা ভগবানের সমাপ্তির দিককেই সত্য বলিয়া আশ্রয় করিয়াছি । তাহাতে ক্ষতি হইত না ; কিন্তু আমরা তাহার ব্যাপ্তির দিকটাকে একেবারেই মিথ্যা বলিয়া, মায়া বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছি। সত্যকে এক অংশে মিথ্যা বলিলেই তাহাকে অপরাংশেও মিথ্যা করিয়া তোলা হয় । আমরা স্থিতিকে আনন্দকে মানিলাম, কিন্তু শক্তিকে দুঃখকে মানিলাম না। তাই আমরা রানীকে অপমান করাতে রাজার স্তব করিয়াও রক্ষা পাইলাম না ; সত্য আমাদিগকে শত শত বৎসর ধরিয়া নানা আঘাতেই মারিতেছেন । সমুদ্রের লোকেরা ভগবানের ব্যাপ্তির দিকটাকেই একেবারে একান্ত সত্য করিয়া ধরিয়া বসিয়া আছে । তাহারা সমাপ্তিকে কোনোমতেই মানিবে না, এই তাহদের পণ । এইজন্য বাহিরের দিকে তাহারা যেমন কেবলই আহরণ করিতেছে অথচ সন্তোষ নাই বলিয়া কিছুকেই লাভ করিতেছে না, তেমনি তত্ত্বজ্ঞানের দিকেও তাহারা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে যে, সত্যের মধ্যে গম্যস্থান বলিয়া কোনো পদার্থই নাই, আছে কেবল গমন । কেবলই হইয়া উঠা, কিন্তু কী যে হইয়া উঠা তাহার কোনো ঠিকানা কোনোখানেই নাই । ইহা এমন একটি সমুদ্রের মতো যাহার কুলও নাই, তালও নাই, আছে কেবল ঢেউ- যাহা পিপাসাও মেটায় না, ফসলও ফলায় না, কেবলই দোলা দেয় । আমরা দেখিলাম আনন্দকে, আর দুঃখকে বলিলাম মিথ্যা মায়া ; উহারা দেখিল দুঃখকে, আর আনন্দকে বলিল মিথ্যা মায়া। কিন্তু, পরিপূর্ণ সত্যের মধ্যে তো কোনোটাই বাদ পড়িতে পারে না ; পূর্ব পশ্চিম সেখানে না মিলিলে পূর্বও মিথ্যা হয়। পশ্চিমও মিথ্যা হয়। আনন্দান্ধেব খঘিমানি ভূতানি জায়ন্তে--- অর্থাৎ আনন্দ হইতেই এই সমস্তু-কিছু জন্মিতেছে- এ কথা যেমন সত্য, স' তপোহতপ্যতা অর্থাৎ তপস্যা হইতে, দুঃখ হইতেই সমন্ত-কিছু সৃষ্ট হইতেছে, এ কথা তেমনি সত্য । গায়কের চিত্তে দেশকালের অতীত গানের পূর্ণ আনন্দও যেমন সত্য আবার দেশকালের ভিতর দিয়া গান গাহিয়া প্ৰকাশ করিবার বেদনাও তেমনি সত্য । এই আনন্দ এবং দুঃখ, এই সমাপ্তি ও ব্যাপ্তি, এই চিরপুরাতন এবং চিরনূতন, এই ধনধান্যপূর্ণ ভূমি ও দুঃখাশ্রচঞ্চল সমুদ্র, উভয়কে মিলিত করিয়া স্বীকার করাই সত্যকে স্বীকার বন্ধুরা। এইজন্য দেখিতেছি, যাহারা চরমকে না মানিয়া কেবল বিকাশকেই মানিতেছে তাহারা উন্মত্ত হইয়া উঠিয়া অপঘাতমুতু্যর অভিমুখে ছুটিতেছে, পদে পদেই তাঁহাদের জাহাজ কেবল আকস্মিক বিপ্লবের চোরা পাহাড়ের উপর গিয়া ঠেকিতেছে। আর যাহারা বিকাশকে মিথ্যা বলিয়া কেবলমাত্র চরমকেই মানিতে চায়, তাহারা নিবীৰ্য ও জীৰ্ণ হইয়া এক শয্যায় পড়িয়া অভিভূত হইয়া মরিতেছে। কিন্তু, চলিতে চলিতে একদিন ঐ ডাঙার গাড়ির এবং সমুদ্রের জাহাজ যখন একই বন্দরে আসিয়া পেঁহিবে এবং দুই পক্ষের মধ্যে পণ্যবিনিময় হইবে তখনই উভয়ে বঁচিয়া যাইবে । নহিলে কেবলমাত্র আপনার পণ্য দিয়া কেহু আপনার দারিদ্র্য ঘুচাইতে পারে না ; বিনিময় না করিতে পারিলে বাণিজ্য চলে না এবং বাণিজ্য না চলিলে লক্ষ্মীর দেখা পাওয়া যায় না । এই বাণিজ্যের যোগেই মানুষ পরস্পর মিলিবে বলিয়াই, পৃথিবীতে ঐশ্বৰ্যদিকে দিকে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। একদা জীবরাজ্যে শ্ৰীপুরুষের বিভাগ ঘটাতেই যেমন দেখিতে দেখিতে বিচিত্ৰ সুখদুঃখের