পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

9Qs up ( এখনকার কালের সুবিখ্যাত লেখক ওয়েলস’ সাহেবের দুই-একখানি নভেল ও আমেরিকার সভ্যতা সম্বন্ধে একখানা বই পূর্বেই পড়িয়ছিলাম। তাঁহাতেই জনিতাম, ইহার চিন্তাশক্তি ইস্পাতের তরবারির মতো যেমন কক্‌মক্‌ করে তেমনি তাহ খারধার। আমার বন্ধু যেদিন ইহার সঙ্গে এক ডিনারে আমাকে নিমন্ত্ৰণ করেন সেদিন আমার মনের মধ্যে কেমন একটু ভয় ছিল। আমার মনে ছিল, সংসারে খরতর বুদ্ধি জিনিসটাতে নিশ্চয়ই অনেক কাজ হয়, কিন্তু তাহার সংস্রব হয়তো varga ng যাহা হউক, সেদিন সন্ধাবেলায় ইহার সঙ্গে অনেকক্ষণের জন্য আলাপ-পরিচয় হইল। প্রথমেই আথান্ত হইলাম যখন দেখা গেল মানুষটি সজারুজাতীয় নহে, সম্পূর্ণ মোলায়েম। দেখিতে পাইলাম, ইহার প্রখরতা চিন্তায়, কিন্তু প্ৰকৃতিতে নয়। আসল কথা, মানুষের প্রতি ইহার আন্তরিক দরদ আছে, অন্যায়ের প্রতি বিদ্বেষ এবং মানুষের সার্বজনীন উন্নতির প্রতি অনুরাগ আছে ; সেইটে থাকিলেই মানুষের মন কেবলমাত্র চিন্তার তুবড়িবাজি করিয়া সুখ পায় না। এই দেশে সেইটে একটা মস্ত জিনিস, মানুষ এখানে সর্বদা প্ৰত্যক্ষগোচর হইয়া আছে ; মানুষের সম্বন্ধে এখানে ঔৎসুক্যের অন্ত নাই। মানুষের প্রতি উদাসীনতার অভাবেই ইহাদের মন এমন প্রচুরশস্যশালী হইয়া উঠিয়াছে। কেননা, শুধু বীজে ও মাটিতে ফসল ভালো হয় না, জমিতে সর্বদা রস থাকা চাই ; মানুষের প্রতি মানুষের টানই সেই চিরন্তন রস যাহাতে করিয়া মনের সকল রকম ফসল একেবারে অপর্যাপ্ত হইয়া ফলিয়া উঠে । আমাদের দেশে আমি অনেক শক্তিশালী লোক দেখিয়ছি, মানুষের সঙ্গে তাহদের হৃদয়ের সংস্রব সুগভীর ও সর্বদা বিদ্যমান নহে বলিয়াই তাহারা আপনার সাধ্যকে পূর্ণভাবে সাধিত করিয়া তুলিতে পারেন না। মানুষ তাহদের কাছে তেমন করিয়া চাহিতেছে না বলিয়াই মানুষের ধন তাহারা পুরা পরিমাণ বাহির করিতে পারিতেছেন না। বিরল-বসতি লোকালয়ে মানুষ নিজের নিতান্ত প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু ফলায় না, এবং তাহারও অনেক নষ্ট হয়, ফেলা যায়। আমাদের সেইরূপ বিরলে বাস ; মানুষ ছিকিয়া বাকিয়া আমাদের হৃদয়মনকে আকর্ষণ করিতেছে না। সেইজন্য আমরা অনেকে চিন্তা করিতে পারি, কিন্তু সে চিন্তা আলস্য ঘুচাইয়া আপনাকে প্রকাশ করিতে পারে না ; অনেকের হৃদয় আছে, কিন্তু সে হৃদয় ছেলে।পুলে-ভাইপো-ভাগনের বাহিরে খাটিবার ক্ষেত্ৰ পায় না। যাহাই হউক, ওয়েলসের সঙ্গে কথা কহিতে গিয়া এইটে বুঝিতে পারিলাম, ইহাদের চিন্তাশীলতা ও রচনাশক্তির অবলম্বন মানুষ ; এইজন্য তাহা শিকারীর শিকার-ইচ্ছার মতো কেবলমাত্র শক্তির খেলা নহে। এইজন্য ইহাদের চিন্তার যে তীক্ষতা তাহা চুরির তীক্ষতার মতো নহে- তাহ সজীব তীক্ষতা, তাহা দৃষ্টির তীক্ষতা ; তাহার সঙ্গে হৃদয় আছে, জীবন আছে। আর-একটা জিনিস দেখিয়া বারবার বিস্মিত হইলাম, সে কথা পূর্বেই বলিয়ছি। সেইহাদের।চিন্তার ক্ষিপ্ৰতা । আমার বন্ধুর সঙ্গে ওয়েলসের যতক্ষণ কথা চলিল ততক্ষণ পদে পদে কথাবার্তার প্রবাহ উজ্জ্বল চিন্তার কণায় ঝলমল করিতে লাগিল। কথার সঙ্গে কথার স্পর্শে আপনি স্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে থাকে, মুহুর্তকাল বিলম্ব হয়না। ইহাতে স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়, ইহাদের মন প্রস্তুত হইয়াই আছে। ইহারা যে চিন্তা করিতেছেন তাহা নহে, চারিদিকের ঠেলায় ইহাদের নিয়ত চিন্তা করাইতেছে ; তাই ইহাদের মন দুটিতে দুটিতেও ভাবিতে পারে এবং ভাবিতে ভাবিতেও কথা কহিয়া যায়। ইহাদের ব্যক্তিগত মনের পশ্চাতে সমন্ত দেশের মন জাগিয়া আছে ; চিন্তার ঢেউ, কথার কল্লোল কেবলই নানা দিক হইতে নানা আকারে পরস্পরের চিত্তকে আঘাত করিতেছে। ইহাতে মনকে জাগ্রত ও মুখরিত না করিয়া থাকিতে পারে না । আমার বন্ধু চিত্রশিল্পী, কথার কারুবার তীহার নৃছে। তঁহার সঙ্গে আমার অনেকদিন অনেক আলাপ হইয়াছে ; সর্বদা ইহাই লক্ষ্য করিয়াছি, যে কথাটাই ইহার সম্মুখে উপস্থিত হয় তৎক্ষণাৎ সেটাকে ইনি Y als für eiger (H. G. Wells)