পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RSO রবীন্দ্র-রচনাবলী এই দীর্ঘাকার কঠিন বিধবাটি বিধাতার কঠোর নিয়মদণ্ডের ন্যায় পল্লীর মস্তকের উপর উদ্যত ছিলেন ; কেহ তাহাকে ভালোবাসিতে অথবা অবহেলা করিতে সাহস করিত না । পল্লীর সকলের সঙ্গেই তাহার যোগ ছিল অথচ তাহার মতো অত্যন্ত একাকিনী কেহ ছিল না । বিধবা নিঃসন্তান ছিলেন । পিতৃমাতৃহীন দুইটি ভ্রাতুষ্পপুত্র তাহার গৃহে মানুব হইত । পুরুষ অভিভাবক অভাবে তাহদের যে কোনো প্রকার শাসন ছিল না এবং মোহান্ধ পিসিমার আদরে তাহারা যে নষ্ট হইয়া যাইতেছিল এমন কথা কেহ বলিতে পারিত না । তাহাদের মধ্যে বড়োটির বয়স আঠারো হইয়াছিল । মাঝে মাঝে তাহার বিবাহের প্রস্তাবও আসিত এবং পরিণয়বন্ধন সম্বন্ধে বালকটির চিত্তও উদাসীন ছিল না । কিন্তু পিসিমা তাহার সেই সুখবাসনায় একদিনের জন্যও প্রশ্ৰয় দেন নাই । অন্য শ্ৰীলোকের ন্যায় কিশোর নবদম্পতির নব প্ৰেমোদগমাদৃশ্য তাহার কল্পনায় অত্যন্ত উপভোগ্য মনোরম বলিয়া প্ৰতীত হইত না । বরং তাহার ভ্রাতুষ্পপুত্র বিবাহ করিয়া অন্য ভদ্র গৃহস্থের ন্যায় আলস্যভরে ঘরে বসিয়া পত্নীর আদরে প্রতিদিন স্কীত হইতে থাকিবে, এ সম্ভাবনা তাহার নিকট নিরতিশয় হেয় বলিয়া প্ৰতীত হইত। তিনি কঠিন ভাবে বলিতেন, পুলিন আগে উপার্জন করিতে আরম্ভ করুক, তার পরে বধূ। ঘরে আনিবে । পিসিমার মুখের সেই কঠোর বাক্যে প্রতিবেশিনীদের হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত । ঠাকুরবাড়িটি জয়কালীর সর্বাপেক্ষা যত্নের ধন ছিল । ঠাকুরের শয়ন বসন মানাহারের তিলমাত্র ক্ৰটি হইতে পারিত না । পূজক ব্ৰাহ্মণ দুটি দেবতার অপেক্ষা এই একটি মানবীকে অনেক বেশি ভয় করিত। পূর্বে এক সময় ছিল যখন দেবতার বরাদ্দ দেবতা পুরা পাইতেন না । কারণ, পূজক ঠাকুরের আর-একটি পূজার প্রতিমা গোপন মন্দিরে ছিল ; তাহার নাম ছিল নিস্তারিণী । গোপনে ঘূত দুগ্ধ ছানা ময়দার নৈবেদ্য স্বর্গে নরকে ভাগাভাগি হইয়া যাইত । কিন্তু আজকাল জয়কালীর শাসনে পূজার বোলো-আনা অংশই ঠাকুরের ভোগে আসিতেছে, উপদেবতাগণকে অন্যত্র জীবিকার অন্য উপায় অন্বেষণ করিতে হইয়াছে । বিধবার যত্নে ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণটি পরিষ্কার তকতক করিতেছে— কোথাও একটি তৃণমাত্ৰ নাই । একপার্থে মঞ্চ অবলম্বন করিয়া মাধবীলতা উঠিয়াছে, তাহার শুকপত্ৰ পড়িবামাত্র জয়কালী তাহা তুলিয়া লইয়া বাহিরে ফেলিয়া দেন । ঠাকুরবাড়িতে পারিপাট্য পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার কিছুমাত্র ব্যাঘাত হইলে বিধবা তাহা সহ্য করিতে পারিতেন না । পাড়ার ছেলেরা পূর্বে লুকাচুরি খেলা উপলক্ষে এই প্রাঙ্গণের প্রান্তে আসিয়া আশ্রয় গ্ৰহণ করিত এবং মধ্যে মধ্যে পাড়ার ছাগশিশু আসিয়া মাধবীলতার বহুলাংশ কিছু কিছু ভক্ষপ করিয়া যাইত । এখন আর সে সুযোগ নাই। পর্বকাল ব্যতীত অন্য দিনে ছেলেরা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিতে পাইত না এবং ক্ষুধাতুর ছাগশিশুকে দণ্ডাঘাত খাইয়াই দ্বারের নিকট হইতে তার স্বরে আপনি আজ-জননীকে আহবান করিতে করিতে ফিরিতে হইত । অনাচারী ব্যক্তি পরমাষ্ট্ৰীয় হইলেও দেবালয়ের প্রাঙ্গণে প্ৰবেশ করিতে পাইত না । জয়কালীর একটি ফকনকরপোক, কুকুটমাংস-লোলুপ। ভগিনীপতি আত্মীয় সম্প্রদর্শন উপলক্ষে গ্রামে উপস্থিত হইয়া মন্দির-অঙ্গনে প্ৰবেশ করিবার উপক্ৰম করিয়াছিলেন, জয়কালী তাহাতে তুরিত ও তীব্র আপত্তি প্ৰকাশ করাতে সহােদরা ভগিনীর সহিত তাহার বিচ্ছেদ সম্ভাবনা ঘটিয়াছিল । এই দেবালয় সম্বন্ধে বিধবার এতই অতিরিক্ত অনাবশ্যক সতর্কতা ছিল যে, সাধারণের নিকট তাহা অনেকটা বাতুলতারূপে zटीग्रमान झ्ठ । জয়কালী আর-সর্বত্রই কঠিন উন্নত স্বতন্ত্র, কেবল এই মন্দিরের সম্মুখে তিনি পরিপূর্ণভাবে আত্মসমৰ্পণ করিয়াছিলেন । এই বিগ্রহটির নিকট তিনি একান্তরূপে জননী, পত্নী, দাসী- ইহার কাছে ! তিনি সতর্ক, সুকোমল, সুন্দর এবং সম্পূর্ণ অবনম্র । এই প্রস্তরের মন্দির এবং প্রস্তরের মূর্তিটি ঠাহি নিগৃঢ় নারীস্বভাবের একমাত্র চরিতার্থতার বিষয় ছিল । ইহাই তাহার স্বামী, পুত্র, তাহার সমস্ত সংসার । ইহা হইতেই পাঠকেরা বুকি কেন, যে—বালকটি মন্দিরপ্রাঙ্গল হইতে মাধবীমণ্ডলী আহরণ করব? প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিল তাহার সাহসের সীমা ছিল না । সে জয়কালীর কনিষ্ঠ ভ্রাতুষ্পপুত্ৰ নলিন । সে তাই’ পিসিনাকে ভালো করিয়াই জানিত- তথাপি তাহার দর্দান্ত প্ৰকতি শাসনের বিশ হয় নাই। যেখানে বিীপ*