set. రిరి এমন করিয়া কিছুদিন সাংসারিক অভাবে এবং মনের কষ্টে কাটিয়া গেল ; অবশেষে শরৎকালে পূজা নিকটবতী হইল। কন্যা এবং জামাতাকে সাদরে আহবান করিয়া আনিবার জন্য রাজকুমারবাবু বহু সমারোহে যানবাহনাদি প্রেরণ করিলেন । এক বৎসর পরে কন্যা স্বামীসহ পুনরায় পিতৃভবনে প্ৰবেশ করিল । ধনী কুটুম্বের যে আদর তাহার অসহ্য হইয়াছিল, জামাতা এবার তদপেক্ষা অনেক বেশি আদর পাইলেন । বিন্ধ্যবাসিনীও অনেককাল পরে মাথার অবগুণ্ঠন ঘুচাইয়া অহনিশি স্বজনস্নেহে ও উৎসবতরঙ্গে আন্দোলিত হইতে লাগিল । আজ ষষ্ঠী । কাল সপ্তমীপূজা আরম্ভ হইবে । ব্যস্ততা এবং কোলাহলের সীমা নাই। দূর এবং নিকট সম্পৰ্কীয় আত্মীয় পরিজনে অট্টালিকার প্রত্যেক প্রকোষ্ঠ একেবারে পরিপূর্ণ । সে রাত্রে বড়ো শ্রান্ত হইয়া বিন্ধ্যবাসিনী শয়ন করিল। পূর্বে যে ঘরে শয়ন করিত এ সে ঘর নহে ; এবার বিশেষ আদর কবিয়া মা জামাতাকে তাহার নিজের ঘর ছাড়িয়া দিয়াছেন । অনাথবন্ধু কখন শয়ন করিতে আসিলেন তাহা বিন্ধ্য জানিতেও পারিল না । সে তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল । খুব ভোরের বেলা হইতে শানাই বাজিতে লাগিল । কিন্তু, ক্লান্তদেহ বিন্ধ্যবাসিনীর নিদ্ৰাভঙ্গ হইল না । কমল এবং ভুবন দুই সখী বিন্ধ্যর শয়নদ্বারে আড়ি পাতিবার নিস্ফল চেষ্টা করিয়া অবশেষে পরিহাসপূর্বক বাহির হইতে উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল ; তখন বিন্ধ্য তাড়াতাড়ি জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, তাহার স্বামী কখন উঠিয়া গিয়াছেন সে জানিতে পারে নাই । লজিত হইয়া শয্যা ছাডিয়া নামিয়া দেখিল, তাহার মাতার লোহার সিন্দুক খোলা এবং তাহার মধ্যে তাহার বাপের যে ক্যাশবাক্সটি থাকিত, সেটিও নাই । তখন মনে পড়িল, কাল সন্ধ্যাবেলায় মায়ের চাবির গোচ্ছা হারাইয়া গিয়া বাড়িতে খুব একটা গোলযোগ পড়িয়া গিয়াছিল । সেই চাবি চুরি করিয়া কোনো একটি চোর এই কাজ করিয়াছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই । তখন হঠাৎ আশঙ্কা হইল, পাছে সেই চোর তাহার স্বামীকে কোনোরূপ আঘাত করিয়া থাকে । বুকটা ধড়াসা করিয়া কঁাপিয়া উঠিল । বিছানার নীচে খুজিতে গিয়া দেখিল, খাটের পায়ের কাছে তাহার মায়ের চাবির গোচ্ছার নীচে একটি চিঠি চাপা রহিয়াছে । চিঠি তাহার স্বামীর হস্তাক্ষরে লেখা। খুলিয়া পড়িয়া জানিল, তাহার স্বামী তাহার কোনো এক বন্ধুর সাহায্যে বিলাতে যাইবার জাহাজ ভাড়া সংগ্ৰহ করিয়াছে, এক্ষণে সেখানকার খরচপত্র চালাইবার অন্য কোনো উপায় ভাবিয়া না পাওয়াতে গতরাত্রে শ্বশুরের অর্থ অপহরণ করিয়া বারান্দা সংলগ্ন কাঠের সিঁড়ি দিয়া অন্দরের বাগানে নামিয়া প্রাচীর লঙঘন করিয়া পলায়ন করিয়াছে। অদ্যই প্ৰত্যুষে জাহাজ ছাডিয়া দিয়াছে। পত্ৰখানা পাঠ করিয়া বিন্ধ্যবাসিনীর শরীরের সমস্ত রক্ত হিম হইয়া গেল । সেইখানেই খাটের খুরা ধরিয়া সে বসিয়া পড়িল । তাহার দেহের অভ্যন্তরে কর্ণকুহরের মধ্যে নিস্তব্ধ মৃত্যুরজনীর ঝিল্লিধ্বনির মতো একটা শব্দ হইতে লাগিল । তাহারই উপরে প্রাঙ্গণ হইতে প্ৰতিবেশীদের বাড়ি হইতে এবং দূর অট্টালিকা হইতে, বহুতর শানাই বহুতর সুরে তান ধরিল । সমস্ত বঙ্গদেশ তখন আনন্দে উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে । শরতের উৎসবহাস্যরঞ্জিত রৌদ্র সকৌতুকে শয়নগৃহের মধ্যে প্ৰবেশ করিল। এত বেলা হইল তথাপি উৎসবের দিনে দ্বার রুদ্ধ দেখিয়া ভুবন ও কমল উচ্চহাস্যে উপহাস করিতে করিতে গুম গুম শব্দে দ্বারে কিল মারিতে লাগিল । তাহাতেও কোনো সাড়া না পাইয়া কিঞ্চিৎ ভীত হইয়া উধৰ্ব্বকণ্ঠে বিন্ধ্যবাসিনী ভগ্নরুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “যাচ্ছি ; তোরা এখন যা ।” তাহারা সখীর পীড়া আশঙ্কা করিয়া মাকে ডাকিয়া আনিল । মা আসিয়া কহিলেন, “বিন্দু, কী হয়েছে মা, এখনো দ্বার বন্ধ কেন ।” বিন্ধ্য উচ্ছসিত অশ্রু সংবরণ করিয়া কহিল, “একবার বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো ।” মা অত্যন্ত ভীত হইয়া তৎক্ষণাৎ রাজকুমারবাবুকে সঙ্গে করিয়া দ্বারে আসিলেন । বিন্ধ্য দ্বার খুলিয়া তীহাদিগকে ঘরে আনিয়া তাড়াতাড়ি বন্ধ করিয়া দিল ।