পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মন্দিরের সঙ্গে ভেদমাত্র নেই, একেবারে মাখামাখি । কেবল, হাটবাজারে যেরকম গোলমাল, এখানে তা দেখা গেল না । চারি দিক নিরালা নয়; অথচ নিভৃত ; স্তব্ধ নয়, শান্ত । আমাদের সঙ্গে ব্ৰহ্মদেশীয় একজন ব্যারিস্টার ছিলেন, এই মন্দির সোপানে মাছমাংস কেনাবেচা এবং খাওয়া চলছে, এর কারণ " তাকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, “বুদ্ধ আমাদের উপদেশ দিয়েছেন, তিনি বলে দিয়েছেন— কিসে মানুষের কল্যাণ, কিসে তার বন্ধন, তিনি তো জোর করে কারো ভালো করতে চান নি ; বাহিরের শাসনে কল্যাণ নেই, অন্তরের ইচ্ছাতেই মুক্তি ; এইজন্যে আমাদের সমাজে বা মন্দিরে আচার সম্বন্ধে জবরদস্তি নেই ।” সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেখানে গেলুম। সেখানে খোলা জায়গা, তারই নানা স্থানে নানারকমের মন্দির । সে মন্দিরে গাভীর্য নেই, কারুকার্যের ঠেসাঠেসি ভিড়, সমস্ত যেন ছেলেমানুষের খেলনার মতো । এমন অদ্ভুত পাঁচমিশালি ব্যাপার আর কোথাও দেখা যায় না— এ যেন ছেলে-ভুলোনো ছড়ার মতো ; তার ছন্দটা একটানা বটে, কিন্তু তার মধ্যে যা-খুশি-তাই এসে পড়েছে, ভাবের পরস্পর-সামঞ্জস্যের কোনো দরকার নেই। বহুকালের পুরাতন শিল্পের সঙ্গে এখনকার কালের নিতান্ত সস্তাদরের তুচ্ছতা একেবারে গায়ে গায়ে সংলগ্ন । ভাবের অসংগতি বলে যে কোনো পদার্থ আছে, এরা তা যেন একেবারে জানেই অসামঞ্জস্যের বন্যা বয়ে যায়, কেবলমাত্র পুঞ্জীকরণটাই তার লক্ষ্য, সজজীকরণ নয়, এও সেইরকম । এক ঘরে অনেকগুলো ছেলে থাকলে যেমন তারা গোলমাল করে, সেই গোলমাল করাতেই তাদের আনন্দ- এই মন্দিরের সাজসজা, প্ৰতিমা, নৈবেদ্য, সমস্ত যেন সেইরকম ছেলেমানুষের উৎসব ; তার মধ্যে অর্থ নেই, শব্দ আছে । মন্দিরের ঐ সোনা-বাধানো পিতল-বাধানো চূড়াগুলি ব্ৰহ্মদেশের ছেলেমেয়েদের আনন্দের উচ্চহাস্যমিশ্রিত হাে হো শব্দ- আকাশে ঢেউ খেলিয়ে উঠছে । এদের যেন বিচার করবার, গম্ভীর হবার বয়স হয় নি । এখানকার এই রঙিন মেয়েরাই সবচেয়ে চোখে পড়ে { এদেশের শাখাপ্ৰশাখা ভরে এরা যেন ফুল ফুটে রয়েছে। ভূঁইচাপার মতো এরাই দেশের সমস্ত- আর কিছু চোখে পড়ে না । লোকের কাছে শুনতে পাই এখানকার পুরুষেরা অলস ও আরামপ্ৰিয়, অন্য দেশের পুরুষের কাজ প্ৰায় সমস্তই এখানে মেয়েরা করে থাকে ৷ হঠাৎ মনে আসে, এটা বুঝি মেয়েদের উপরে জুলুম করা হয়েছে । কিন্তু, ফলে তো তার উলটোই দেখতে পাচ্ছি- এই কাজকর্মের হিল্লোলে মেয়েরা আরো যেন বেশি করে বিকশিত হয়ে উঠেছে। কেবল বাইরে বেরতে পারাই যে মুক্তি তা নয়, অবাধে কাজ করতে পাওয়া মানুষের পক্ষে তার চেয়ে বড়ো মুক্তি । পরাধীনতাই সবচেয়ে বড়ো বন্ধন নয়, কাজের সংকীর্ণতাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠোর খাচা । এখানকার মেয়েরা সেই খাচা থেকে ছাড়া পেয়ে এমন পূর্ণতা এবং আত্মপ্ৰতিষ্ঠা লাভ করেছে | তারা নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিজের কাছে সংকুচিত হয়ে নেই ; রমণীর লাবণ্যে যেমন তারা প্ৰেয়সী, শক্তির মুক্তিগৌরবে তেমনি তারা মহীয়সী । কাজেই যে মেয়েদের যথার্থ শ্ৰী দেয়, সাওতাল মেয়েদের দেখে তা আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলুম। তারা কঠোর পরিশ্রম করে, কিন্তু কারিগর। যেমন কঠিন আঘাতে মূর্তিটিকে সুব্যক্ত করে তোলে তেমনি এই পরিশ্রমের আঘাতেই এই সাওতাল মেয়েদের দেহ এমন নিটােল, এমন সুব্যক্ত হয়ে ওঠে ; তাদের সকল প্রকার গতিভঙ্গিতে এমন একটা মুক্তির মহিমা প্ৰকাশ পায় । কবি কীটস বলেছেন, সত্যই সন্দর । অর্থাৎ, সত্যের বাধামুক্ত সুসম্পূর্ণতাতেই সৌন্দর্য । সত্য মুক্তি লাভ করলে আপনিই সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় । প্রকাশের পূর্ণতাই সৌন্দর্য, এই কথাটাই আমি উপনিষদের এই বাণীতে অনুভব করি।- আনন্দরাপমমৃতং যদবিভাতি ; অনন্তস্বরূপ যেখানে প্ৰকাশ পাচ্ছেন, সেইখানেই তার অমৃতরােপ, আনন্দরূপ । মানুষ ভয়ে লোভে ঈর্ষায় মূঢ়তায় প্রয়োজনের সংকীর্ণতায় এই প্ৰকাশকে আচ্ছন্ন করে, বিকৃত করে ; এবং সেই বিকৃতিকেই অনেকসময় বড়ো নাম দিয়ে বিশেষ ভাবে আদর করে থাকে । তোসামারু জাহাজ Sq. (Kur Sves e