পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

३९७ রবীন্দ্র-রচনাবলী পরাভব ঘটে ; পুরুষ যায় প্ৰমত্ততার রসাতলে, আর নারীর হৃদয়ে যে রসের পাত্ৰ আছে তা ভেঙে গিয়ে সে-রস ধুলাকে পঙ্কিল করে। ক্রকোভিয়া ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ ফুলের মধ্যে যে-আনন্দ সে প্রধানত ফলের প্রত্যাশার আনন্দ এটা অত্যন্ত মোটা কথা । বিশ্বসৃষ্টিতে দেখতে পাই সৃষ্টিতেই আনন্দ, হওয়াটাই চরম কথা। তার ফুলেও আছে হওয়া, ফলেও আছে হওয়া । ফুলটা হল উপায় আর ফলটা হল উদ্দেশ্য, তাই বলে উভয়ের মধ্যে মূল্যের কোনো ভেদ দেখতে পাই নে । আমার তিনবছরের প্ৰিয়সখী, যাকে নাম দিয়েছি। নন্দিনী, তার হওয়ার উদ্দেশ্য কী এ প্রশ্নের কোনো জবাব-তলবের কথা মনে আসে না । সে-যে কুলরক্ষার সেতু, সে-যে পিণ্ড-জোগানের হেতু, সে-যে কোনো এক ভাবীকালে প্ৰজনাৰ্থং মহাভাগা, এ-সব হল শাস্ত্ৰসংগত বিজ্ঞানসম্মত মূল্যের কথা। ফলের দরে ফুলের বিচার ব্যাবসাদারের । কিন্তু, ভগবান তো সৃষ্টির ব্যাবসা ফাঁদেন নি। তার সৃষ্টি একেবারেই বাজে খরচ ; অর্থাৎ, আয় করবার জন্যে খরচ করা নয়, এইজন্যই আয়োজনে প্রয়োজনে সমান হয়ে মিশে গেছে। এইজন্য যে-শিশু জীবলোকের প্রয়োজনসাধনের পক্ষে অপূর্ণ, সেই তিন বছরের শিশুর অপূর্ণতাই সৃষ্টির আনন্দগীেরবে পূর্ণ। আমি তো দেখি বিশ্বরচনায় মুখ্যের চেয়ে গৌণটাই বড়ো। ফুলের রঙের মুখ্য কথাটা হতে পারে পতঙ্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ; গৌণ কথাটা হচ্ছে সৌন্দর্য। মানুষ যখন ফুলের বাগান করে তখন সেই গীেণের সম্পদই সে খোজে। বস্তুত, গৌণ নিয়েই মানুষের সভ্যতা । মানুষ কবি যখন প্ৰেয়সীর মুখের একটি তিলের জন্য সমরখন্দ বোখার পণ করতে বসে তখন সে প্ৰজনাৰ্থং মহাভাগার কথা মনেই রাখে না । এই বে-হিসাবি সৃষ্টিতে বে-হিসাবি আনন্দরূপকেই সে সৃষ্টির ঐশ্বৰ্য বলে জানে। প্ৰাণীসংসারে জৈবপ্রকৃতিই সকলের গোড়ায় আপন ভিত ফেদে, জাজিম পেতে, আলো জেলে, পৃথিবীর ভাণ্ডার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্ৰ মালমসলা নিজের ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে সংসার পেতে বসেছিল। ভোরের বেলায় সে মুখ্য জায়গাটা দখল করে বসল। তারই বচন হচ্ছে, সা ভার্য যা প্ৰজাবতী । অর্থাৎ, যদি কাজে লাগল। তবেই তার দাম । চিৎপ্রকৃতি এসে জুটলেন কিছু দেরিতে। তাই, জৈবপ্রকৃতির আশ্রয়ে তাকে পরাভূত হতে হল। পুরানো পথে পুরানো ঘাটে পুরানো কালের মালমসলা নিয়েই সে ফান্দলে তার নিজের ব্যাবসা | তখন সে সাবেক আমলের মুখ্য থেকে হাল আমলের গৌণ ফলিয়ে তুলতে বসল। আহারকে করে তুললে ভোজ, শব্দকে করে তুললে বাণী, কান্নাকে করে তুললে কাব্য। মুখ্যভাবে যেটা ছিল আঘাত গৌণভাবে সেটা হল আবেদন ; যেটা ছিল বন্দিনীর শৃঙ্খল, সেটা হল বধুর কঙ্কণ ; যেটা ছিল ভয় সেটা হল ভক্তি ; যেটা ছিল দাসত্ব সেটা হল আত্মনিবেদন । যারা উপরের স্তরের চেয়ে নীচের স্তরকে বিশ্বাস করে বেশি তারা মাটি খোড়াখুড়ি করতে গেলেই পুরাতন তাম্রশাসন বেরিয়ে পড়ে। বৈজ্ঞানিকের চশমায় ধরা পড়ে যে, খেতের মালিক জৈবপ্রকৃতি ; অতএব ফসলের অধিকার নির্ণয় করতে গেলে বৈজ্ঞানিকের কাছে চিৎপ্রকৃতির দাবি অগ্রাহ্য হয়ে আসে। আপিলে সে যতই বলে “প্ৰণালী আমার, প্ল্যান আমার, হাললাঙল আমার, চাষ আমার” কিছুতেই অপ্ৰমাণ করতে পারে না যে, মাটির তলাকার তাম্রশাসনে মোটা অক্ষরে খোদা আছে ‘জৈবপ্রকৃতি । মোটা অক্ষরের উপরে বিচারকের নজরও পড়ে বেশি । কাজেই, রায় যখন বেরীয় তখন পাকা প্ৰমাণসহ প্ৰকাশ হয়ে পড়ে যে, সাবেক আমলের ভূতই বর্তমান আমলে ভগবান সেজে এসেছে। জৈবপ্রকৃতিতে শিশুর একটা অর্থ আছে। সেই অর্থটাকেই যদি সম্পূর্ণ বলে স্বীকার করে নিই তা