পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Ե Հ রবীন্দ্র-রচনাবলী উত্তাপের পরিমাণ বেড়ে বেড়ে ক্রমে যেমন তা আলোকিত হয়, দুঃখের তেমনি পরিমাণভেদে প্ৰকাশভেদ হয়ে থাকে। যে-দুঃখ প্ৰথমে কারাগারের মতো বিশ্ব থেকে পৃথক করে মনকে কেবলমাত্র নিজের ব্যথার মধ্যেই বদ্ধ করে, সেই দুঃখেরই বেগ বাড়তে বাড়তে অবশেষে অবরোধ ভেঙে পড়ে এবং বিশ্বের দুঃখসমুদ্রের কোটালের বানকে অন্তরে প্রবেশ করবার পথ ছেড়ে দেয় । তখন নিজের ক্ষণিক ছোটাে দুঃখটা মানুষের চিরকালীন বড়ো দুঃখের সামনে স্তন্ধ হয়ে দাড়ায় ; তার ছটুফটানি চলে যায়। তখন দুঃখের দণ্ডটা একটা দীপ্ত আনন্দের মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। প্ৰলয়কে ভয় যেই না-করা যায় অমনি দুঃখবীণার সুর বাধা সাঙ্গ হয়। গোড়ায় ঐ সুর-বধবার সময়টাই হচ্ছে বড়ো কৰ্কশ, কেননা, তখনো যে দ্বন্দ্ব ঘোচে নি । এই অভিজ্ঞতার সাহায্যে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের অবস্থা কল্পনা করতে পারি। বোধ হয়, প্ৰথম অবস্থায় ভয়ে ভরসায় যতক্ষণ টানাটানি চলতে থাকে ততক্ষণ ভারি কষ্ট । যতক্ষণ ভীষণকেই একমাত্র করে দেখি নে, যতক্ষপে তাকে অতিক্রম করেও জীবনের চিরপরিচিত ক্ষেত্রটা দেখা যায়, ততক্ষণ সেই স্বন্ধের টানে ভয় কিছুতেই ছাড়তে চায় না। অবশেষে তাপের তীব্ৰতা বাড়তে বাড়তে রুদ্র যখন অদ্বিতীয় হয়ে দেখা দেন, প্রলয়ের গর্জন তখন সংগীত হয়ে ওঠে ; তখন তার সঙ্গে নির্বিচারে সম্পূর্ণভাবে যোগ দেবার নিরতিশয় আগ্ৰহে মরিয়া করে তোলে। মৃত্যুকে তখন সত্য বলে জেনে গ্ৰহণ করি ; তার একটা পূর্ণাত্মক রূপ দেখতে পাই বলে, তার শূন্যাত্মিকতার ভয় চলে যায়। কয়দিন রুদ্ধকক্ষে সংকীর্ণ শয্যায় পড়ে পড়ে মৃত্যুকে খুব কাছে দেখতে পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল প্রাণকে বহন করবার যোগ্য শক্তি আমার শেষ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় প্রথম ইচ্ছার ধাকাটা ছিল দেশের আকাশে প্রাণীটাকে মুক্ত করে দেওয়া । ক্রমে সেই ইচ্ছার বন্ধন শিথিল হয়ে এল । তখন মৃত্যুর পূর্বেই ঘরের বাইরে নিয়ে যাবার যে-প্ৰথা আমাদের দেশে আছে, তার অর্থটা মনে জেগে উঠল। ঘরের ভিতরকার সমস্ত অভ্যন্ত জিনিস হচ্ছে প্ৰাণের বন্ধনজাল । তারা সকলে মিলে মৃত্যুকে তীব্ৰভাবে প্ৰতিবাদ করতে থাকে । জীবনের শেষ ক্ষপে মনের মধ্যে এই দ্বন্ধের কোলাহল যদি জেগে ওঠে। তবে তাতেই বেসুর কর্কশ হয় ; মৃত্যুর সম্পূর্ণ সংগীত শুনতে পাই নে, মৃত্যুকে সত্য বলে স্বীকার করে নেবার আনন্দ চলে যায় । , বহুকাল হল আমি যখন প্ৰথম কাশীতে গিয়েছিলাম। তখন মৃত্যুকালের যে-একটি মনোহর দৃশ্য চোখে পড়েছিল, তা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না । ঠিক মনে নেই, বোধ করি তখন শরৎকাল ; নির্মল আকাশ থেকে প্রভাতসূৰ্য জীবধাত্রী বসুন্ধরাকে আলোকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে। এপারের লোকালয়ের বিচিত্ৰ চাঞ্চল্য, ওপারের প্রান্তরের সুদূরবিতীর্ণ নিন্তৰুতা, মাঝখানে জলধারা— সমস্তকে দেবতার পরশমণি ছোয়ানো হল । নদীর ঠিক মাঝখানে দেখি একটি ডিঙি নৌকা খরস্রোতে ছুটে চলেছে। আকাশের দিকে মুখ করে মুমূর্ব স্তন্ধ হয়ে শুয়ে আছে, তারই মাথার কাছে করতাল বাজিয়ে উচ্চস্বরে কীর্তন চলছে। নিখিল বিশ্বের বক্ষের মাঝে মৃত্যুর যে-পরম আহবান, আমার কাছে তারই সুগভীর সুরে আকাশ পূর্ণ হয়ে উঠল। যেখানে তার আসন সেখানে তার শান্তরূপ দেখতে পেলে মৃত্যু যে কত সুন্দর, তা স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হয় । ঘরের মধ্যে সমস্তই তাকে উচ্চৈঃস্বরে অস্বীকার করে ; সেইজন্য সেখানকার খটপালঙ সিন্দুক চৌকি দেওয়াল কড়ি বরগা, সেখানকার প্রাত্যহিক ক্ষুধাতৃষ্ণা কর্ম ও বিশ্রামের ছোটোখাটাে সমান্ত দাবিতে মুখর চিৎকােল ঘরকল্পনার ব্যন্তর্তার মাঝখানে সমান্ত ভিড় ঠেলে, সমস্ত আপত্তি অতিক্রম করে, মৃত্যু যখন চিরতরের লিপি হাতে নিয়ে প্রবেশ করে তখন তাকে দাসু বলে ভ্ৰম হয় ; তখন তার হাতে মানুষ আত্মসমৰ্পণ করবার আনন্দ পায় না। মৃত্যু বাধন ছিন্ন করে দেবে, এইটেই কুৎসিত । আপনি বাধন আলগা করে দিয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে তার হাত ধারব, এইটেই সুন্দর । হিন্দু কাশীকে পৃথিবীর বাহিরের স্থান বলেই বিশ্বাস করে। তার কাছে কাশীর ভৌগোলিক সীমানা একটা মায়া, পরমাৰ্থত সেখানে নিখিল বিশ্বের পরিচয়, সেখানে বিশ্বেশ্বরের আসন । অতএব, বিশেষ দেশবাসীর কাছে বিশেষ দেশের বে আকর্ষণবেগ তার প্রাণকে সেখানকার মাটি জল আকাশের সঙ্গে