পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যাত্রী (SS পদেই পাহাড় ঝরনা নদী প্রান্তর অরণ্য অগ্নিগিরি সরোবর । অথচ, দেশটি চলাফেরার পক্ষে সুগম, নদী পর্বতের পরিমাণ ছোটাে ; প্রজাসংখ্যা বেশি, ভূমির পরিমাণ কম, এইজন্যে কৃষির উৎকর্ষ দ্বারা চাষের-যোগ্য সমস্ত জমি সম্পূর্ণরূপে এরা চষে ফেলেছে ; খেতে খেতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল সেঁচ দেবার ব্যাপক ব্যবস্থা এ দেশে দীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত। এখানে দারিদ্র্য নেই, রোগ নেই, জলবায়ু সুখকর । দেবদেবীবহুল, কাহিনীবহুল, অনুষ্ঠানবহুল পৌরাণিক হিন্দুধর্ম এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে সংগত ; সেই প্রকৃতি এখানকার শিল্পকলায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে, বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের প্রবর্তন করেছে । জাপানের সঙ্গে এর মস্ত একটা তফাত । জাপান শীতের দেশ ; জাভা বালি গরমের দেশ । জাপান নি। আত্মরক্ষার জন্যে যে দৃঢ়নিষ্ঠ অধ্যবসায় দরকার এদের তা ছিল না । গরম হাওয়া প্ৰাণের প্রকাশকে যেমন তাড়াতাডি পরিণত করে তেমনি তাড়াতাড়ি ক্ষয় করতে থাকে । মুহুর্তে মুহুর্তে শক্তিকে সে শিথিল করে, জীবনের অধ্যবসায়কে ক্লান্ত করে দেয় । বাটাভিয়া শহরটি-যে এমন নিখুঁত ভাবে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন তার কারণ, শীতের দেশের মানুষ এর ভার নিয়েছে ; তাদের শীতের দেশের দেহে শক্তি অনেক কাল থেকে বংশানুক্রমে অস্থিতে মজ্জাতে পেশীতে স্নায়ুতে পুঞ্জীভূত ; তাই তাদের অক্লান্ত মন সর্বত্র ও প্রতি মুহুর্তে আপনাকে প্রয়োগ করতে পারে । আমরা কেবলই বলি, “যথেষ্ট হয়েছে, তুমিও যেমন, চলে যাবে।” যত্ন জিনিসটা কেবল হৃদয়ের জিনিস নয়, শক্তির জিনিস । অনুরাগের আগুনকে জ্বালিয়ে রাখতে শক্তির প্রাচুর্য চাই । শক্তিসঞ্চয় যেখানে অল্প সেখানে আপনিই বৈরাগ্য এসে পড়ে । বৈরাগ্য নিজের উপর থেকে সমস্ত দাবি কমিয়ে দেয় । বাইরের অসুবিধা, অস্বাস্থ্য, অব্যবস্থা, সমস্তই মেনে নেয় । নিজেকে ভোলাবার জন্যে বলতে চেষ্টা করে যে, ওগুলো সহ্য করার মধ্যে যেন মহত্ত্ব আছে । যার শক্তি অজস্র সে সমস্ত দাবি মেনে নিতে আনন্দ পায় ; এইজন্যেই সে জোরের সঙ্গে বেঁচে থাকে, ধ্বংসের কাছে সহজে ধরা দিতে চায় না । যুরোপে গেলে সব চেয়ে আমার চােখে পড়ে মানুষের এই সদাজাগ্ৰত যত্ন । যাকে বলি বিজ্ঞান, সায়ান্স, তার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে জ্ঞানের জন্যে অপরাজিত যত্ন । কোথাও আন্দাজ খাটবে না, খেয়ালকে মানবে না, বলবে না। “ধরে নেওয়া যাক”, বলবে না “সর্বজ্ঞ ঋষি এই কথা বলে গেছেন” । জ্ঞানের ক্ষেত্রে, নীতির ক্ষেত্রে, যখন আত্মশক্তির ক্লাস্তি আসে তখন বৈরাগ্য দেখা দেয় ; সেই বৈরাগ্যের অযত্নের ক্ষেত্ৰেই ঋষিবাক্য, বেদবাক্য, গুরুবাক্য, মহাত্মাদের অনুশাসন, আগাছার জঙ্গলের মতো জেগে ওঠে।— নিত্যপ্ৰয়াসীসাধ্য জ্ঞানসাধনার পথ রুদ্ধ করে ফেলে। বৈরাগ্যের অযত্নে দিনে দিনে চারি দিকে যে প্রভূত আবর্জনার অবরোধ জমে ওঠে তাতেই মানুষের পরাভব ঘটায় । বৈরাগ্যের দেশে শিল্পকলাতেও মানুষ অন্ধ পুনরাবৃত্তির প্রদক্ষিণপথে চলে, এগোয় না, কেবলই ঘোরে । মাদ্রাজের শ্রেষ্ঠী পয়ত্ৰিশ লক্ষ টাকা খরচ করে, হাজার বছর আগে যে মন্দির তৈরি হয়েছে ঠিক তারই নকল করবার জন্যে । তার বেশি তার পায় না । খাচার কাছে হার মেনে যে-পাখি চিরকালের মতো ধরা দিয়েছে সমস্ত বিশ্বের কাছে তাকে হার মানতে হল । এ দেশে এসে প্ৰথমে আনন্দ হয় এখানকার সব অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্যে ও সৌন্দর্যে । তার পরে ক্রমে মনে সন্দেহ হতে থাকে, এ হয়তো খাচার সৌন্দর্য, নীড়ের সৌন্দর্য নয়- এর মধ্যে হয়তো চিত্তের স্বাধীনতা নেই। অভ্যাসের যন্ত্রে নিখুঁত নকল শত শত বৎসর ধরে ধারাবাহিক ভাবে চলেছে। আমরা যারা এখানে বাহির থেকে এসেছি আমাদের একটা দুর্লভ সুবিধা ঘটেছে এই যে, আমরা অতীত কালকে বর্তমানভাবে দেখতে পাচ্ছি । সেই অতীত মহৎ, সেই অতীতের ছিল প্ৰতিভা, যাকে বলে নব-নবােন্মেষশালিনী বুদ্ধি ; তার প্রাণশক্তির বিপুল উদ্যম আপন শিল্পসৃষ্টির মধ্যে প্রচুরভাবে আপন পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তবুও সে অতীত, তার উচিত ছিল বর্তমানের পিছনে পড়া ; সামনে এসে দাড়িয়ে বর্তমানকে সে ঠেকিয়ে রাখল কেন । বর্তমান সেই অতীতের বাহনমাত্র হয়ে বলছে, “আমি