পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(88 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সম্পূৰ্ণ আপন করে নিয়েছেন । জাভানিদের নাচ গান শিল্প ইতিহাস প্রভৃতিকে বঁচিয়ে রাখবার জন্যে তার একান্ত যত্ন । এই সমস্ত আলোচনার জন্যে ‘জাভা সোসাইটি” বলে একটি সভা স্থাপিত হয়েছে, তারই পরিচালনার জন্যে এর সমস্ত সময় ও চেষ্টা নিযুক্ত । আমার বর্ণনা থেকে বুঝবে, এই সরল আত্মত্যাগী মানুষটিকে আমরা ভালোবেসেছি। বোরোবুদুরের উদ্দেশে যে কবিতা” লিখেছি সেটি অন্য পাতায় তোমাদের জন্যে কপি করে পাঠানো গেল । ইতি -২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ * Σ δ বাশুড়ঙ । জাভা মীরা, এখানকার যা-কিছু দেখবার তা শেষ করেছি। যোগ্য থেকে গিয়েছিলুম বোরোবুদুরে ; সেখানে একরাত্ৰি কাটিয়ে এলুম । প্ৰথমে দেখলুম, মুণ্ডুঙ বলে এক জায়গায় একটি ছোটাে মন্দির । ভেঙেচুরে পড়ছিল, সেটাকে এখানকার গবর্মেন্ট সারিয়ে নিয়েছে। গড়নটি বেশ লাগল দেখতে । ভিতরে বুদ্ধের তিন ভাবের তিন বিরাট মূর্তি । স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে দেখলেম । মনের ভিতরে কেমন একটা বেদনা বোধ হয় । একদিন অনেক মানুষে মিলে এই মন্দির, এই মূর্তি, তৈরি করে তুলছিল । সে কত কোলাহল, কত আয়োজন, তার সঙ্গে সঙ্গে ছিল মানুষের প্রাণ। এই প্ৰকাণ্ড পাথরের প্রতিমা যেদিন পাহাড়ের উপর তোলা হচ্ছিল সেদিন এই গাছপালার মধ্যে এই সূর্যালোকে উজ্জ্বল আকাশের নীচে মানুষের বিপুল একটা প্ৰয়াস সজীবিভাবে এইখানে তরঙ্গিত । পৃথিবীতে সেদিন খবর-চালাচালি ছিল না ; এই ছোটাে দ্বীপটির মধ্যে যে প্রবল ইচ্ছা আপন কীর্তিরচনায় প্ৰবৃত্ত, সমুদ্র পার হয়ে তার সংবাদ আর কোথাও পৌছয় নি । কলকাতার ময়দানের ধারে যখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরি হচ্ছিল তার কোলাহল পৃথিবীর সকল সমুদ্রের কুলে কুলে বিস্তীর্ণ হয়েছিল । - নিশ্চয় দীর্ঘকাল লেগেছিল। এই মন্দির তৈরি হতে ; কোনো-একজন মানুষের আয়ুর মধ্যে এর সৃষ্টির সীমা ছিল না । এই মন্দিরকে তৈরি করে তোলবার জন্যে যে প্ৰবল শ্রদ্ধা সেটা তখনকার সমস্ত কাল জুড়ে সত্য ছিল । এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে কত বিস্ময়, কত বিতর্ক, সত্যমিথ্যা কত কাহিনী তখনকার এই দ্বীপের সুখদুঃখবিক্ষুব্ধ প্রতিদিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত হয়েছে। একদিন মন্দির তৈরি শেষ হল ; তার পরে দিনের পর দিন। এখানে পূজার দীপ জ্বলেছে, দলে দলে পূজার অর্ঘ্য এনেছে, বৎসরের বিশেষ বিশেষ দিনে পার্বণ হয়েছে, এর প্রাঙ্গণে তীর্থযাত্রী মেয়ে পুরুষ এসে ভিড় করেছে। তার পরে সেদিনের ভাষার উপর, ভাবের উপর, ধুলো চাপা পড়ল ; সেদিন যা অত্যন্ত সত্য ছিল তার অর্থ গেল হারিয়ে । কারনা শুকিয়ে গেলে যেমন কেবল পাথরগুলো বেরিয়ে পড়ে, এই সব মন্দির আজ তেমনি । একে ঘিরে যে প্রাণের ধারা নিরস্তর বয়ে যেত সে যেমনি দূরে সরে গেল, অমনি এর পাথর আর কথা কয় না, এর উপরে সেদিনের প্রাণস্রোতের কেবল চিহ্নগুলি আছে, কিন্তু তার গতি নেই, তার বাণী নেই । মোটরগাড়ি চড়ে আমরা একদল এলুম দেখতে, কিন্তু দেখবার আলো কোথায় । মানুষের এই কীর্তি আপন প্রকাশের জন্যে মানুষের যে-দৃষ্টির অপেক্ষা করে, কতকাল হল, সে লুপ্ত হয়ে গেছে । ১ বোরোবুদুর । পরিশেষ কাব্যে সংকলিত। ১৫শ খণ্ড (সুলভ ৮ম খণ্ড) রবীন্দ্র-রচনাবলী দ্রষ্টব্য। ২। প্ৰতিমা দেবীকে লিখিত ।