পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ と28 রবীন্দ্র-রচনাবলী এরা একা, অত্যন্ত ভাঙাচােরা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার বোঝা নিয়ে। পথ পূর্বতন দুঃশাসনের প্রভূত আবর্জনায় দুৰ্গম । যে আত্মবিপ্লবের প্রবল ঝড়ের মুখে এরা নবযুগের ঘাটে পাড়ি দিলে সেই বিপ্লবের প্ৰচ্ছন্ন এবং প্রকাশ্য সহায় ছিল ইংলন্ড এবং আমেরিকা । অর্থসম্বল এদের সামান্য ; বিদেশের মহাজনী গদিতে এদের ক্রেডিট নেই । দেশের মধ্যে কলকারখানা। এদের যথেষ্ট পরিমাণে না থাকাতে অর্থ-উৎপাদনে এরা শক্তিহীন । এইজন্যে কোনোমতে পেটের ভাত বিক্রি করে চলছে। এদের উদ্যোগপর্ব । অথচ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সকলের চেয়ে যে অনুৎপাদক বিভাগ- সৈনিক-বিভাগ— তাকে. সম্পূর্ণরূপে সুদক্ষ রাখার অপব্যয় এদের পক্ষে অনিবার্য। কেননা আধুনিক মহাজনী যুগের সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি এদের শত্রুপক্ষ এবং তারা সকলেই আপন আপনি অস্ত্রশালা কানায় কানায় ভরে তুলেছে। মনে আছে, এরাই ‘লীগ অব নেশনস’এ অস্ত্রবর্জনের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়ে কপট শান্তিকামীদের মনে চমক লাগিয়ে দিয়েছিল । কেননা নিজেদের প্রতাপ-বর্ধন বা রক্ষণ সোভিয়েটদের লক্ষ্য নয়- এদের সাধনা হচ্ছে জনসাধারণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অন্নসম্বলের উপায়-উপকরণকে প্রকৃষ্ট প্রণালীতে ব্যাপক করে গড়ে তোলা, এদেরই পক্ষে নিরুপদ্রব শান্তির দরকার সব চেয়ে বেশি । কিন্তু তুমি তো জােন, “লীগ অব নেশনস এর সমস্ত পালোয়ানই গুণ্ডাগিরির বহুবিস্তৃত উদ্যোগ কিছুতেই বন্ধ করতে চায় না, কিন্তু “শান্তি চাই’ বলে সকলে মিলে হাক পাড়ে । এইজন্যেই সকল সাম্রাজ্যিক দেশেই অস্ত্রশস্ত্রের কাটাবনের চাষ অন্নের চাষকে ছাপিয়ে বেড়ে চলেছে । এর মধ্যে আবার কিছুকাল ধরে রাশিয়ায় অতি ভীষণ দুৰ্ভিক্ষ ঘটেছিল ; কত লোক মরেছে তার ঠিক নেই। তার ধাক্কা কাটিয়ে সবেমাএ আট বছর এরা নূতন যুগকে গড়ে তোলবার কাজে লাগতে পেরেছে, বাইরের উপকরণের অভাব সত্ত্বেও । কােজ সামান্য নয়- য়ুরোপ-এশিয়া জুড়ে প্রকাণ্ড এদের রাষ্ট্রক্ষেত্র । প্রজামণ্ডলীর মধ্যে যত বিভিন্ন জাতের মানুষ আছে ভারতবর্ষেও এত নেই। তাদের ভূপ্রকৃতি মানবপ্রকৃতির মধ্যে পরস্পর পার্থক্য অনেক বেশি। বস্তুত এদের সমস্যা বহুবিচিত্র-জাতি-সমাকীর্ণ, বহুবিচিত্র-অবস্থা-সংকুল বিশ্বপূথিবীর সমস্যারই সংক্ষিপ্ত রূপ । তোমাকে পূর্বেই বলেছি, বাহির থেকে মস্কো শহরে যখন চােখ পড়ল দেখলুম, য়ুরোপের অন্য সমস্ত ধনী শহরের তুলনায় অত্যন্ত মলিন । রাস্তায় যারা চলেছে তারা একজনও শৌখিন নয়, সমস্ত শহর আটপৌরে-কাপড়-পরা । আটপৌরে কাপড়ে শ্রেণীভেদ থাকে না, শ্রেণীভেদ পোশাকী কাপড়ে । এখানে সাজে পরিচ্ছদে সবাই এক । সবটা মিলেই শ্রমিকদের পাড়া ; যেখানে দৃষ্টি পড়ে সেখানেই ওরা । এখানে শ্রমিকদের কৃষাণদের কিরকম বদল হয়েছে তা দেখবার জন্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই খুলতে অথবা গীয়ে কিংবা বস্তিতে গিয়ে নােট নিতে হয় না। যাদের আমরা ‘ভদ্র লোক’ বলে থাকি তারা কোথায় সেইটেই জিজ্ঞাস্য । । এখানকার জনসাধারণ ভদ্রলোকের আওতায় একটুও ছায়া ঢাকা পড়ে নেই, যারা যুগে যুগে নেপথ্যে ছিল তারা আজ সম্পূৰ্ণ প্রকাশ্যে । এরা যে প্ৰথমভাগ শিশুশিক্ষা পড়ে কেবলমাত্র ছাপার অক্ষর হাৎড়ে বেড়াতে শিখেছে, এ ভুল ভাঙতে একটুও দেরি হল না । এরা মানুষ হয়ে উঠেছে এই কটা বছরেই । নিজের দেশের চাষীদের মজুরদের কথা মনে পড়ল । মনে হল, আরব্য উপন্যাসের জাদুকরের কীর্তি । বছর দশেক আগেই এরা ঠিক আমাদেরই দেশের জন-মজুরদের মতোই নিরক্ষর নিঃসহায় নিরন্ন ছিল, তাদেরই মতো অন্ধসংস্কার এবং মূঢ় ধাৰ্মিকতা । দুঃখে বিপদে এরা দেবতার দ্বারে মাথা খুঁড়েছে ; পরলোকের ভয়ে পাণ্ডাপুরুতদের হাতে এদের বুদ্ধি ছিল বাধা, আর ইহলোকের ভয়ে রাজপুরুষ মহাজন ও জমিদারের হাতে ; যারা এদের জুতো-পেটা করত তাদের সেই জুতো সাফ করা এদের কাজ ছিল । হাজার বছর থেকে এদের প্রথাপদ্ধতির বদল হয় নি ; যান-বাহন চরকা-ঘানি সমস্ত প্ৰপিতামহের আমলের, হালের হাতিয়ারে হাত লাগাতে বললে বেঁকে বসত । আমাদের দেশের ত্রিশ কোটির থিঠের উপরে যেমন চেপে বসেছে ভূতকালের ভূত, চেপে ধরেছে তাদের দুই চোখএদেরও ঠিক তেমনিই ছিল । ক'টা বছরের মধ্যে এই মূঢ়তার অক্ষমতার অভ্ৰভেদী পাহাড় নড়িয়ে