পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাশিয়ার চিঠি @ Գ Տ ছিল, রাশিয়ায় প্রজাসাধারণের উন্নতিবিধান ভারতবর্ষের চেয়ে বেশি দুরূহ বৈ কম নয় । প্রথমত এখানকার সমাজে যারা ভদ্রেতর শ্রেণীতে ছিল আমাদের দেশের সেই শ্রেণীর লোকের মতোই তাদের অন্তর-বাহিরের অবস্থা । সেইরকমই নিরক্ষর নিরুপায়, পূজাৰ্চনা পুরুতপাণ্ডা দিনক্ষণ তাগাতাবিজে বুদ্ধিসুদ্ধি সমস্ত চাপা-পড়া, উপরও আলাদের পায়ের ধুলোতেই মলিন তাদের আত্মসম্মান, আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের সুযোগ-সুবিধা তারা কিছুই পায় নি, প্রপিতামহদের ভূতে-পাওয়া তাদের ভাগ্য, সেই ভূত তাদের বেঁধে রেখেছে হাজার বছরের আগেকার অচল খোটায়- মাঝে মাঝে য়িহুদী প্রতিবেশীদের পরে খুন চেপে যায়, তখন পাশবিক নিষ্ঠুরতার আর অন্ত থাকে না । উপরওআলাদের কাছ থেকে চাবুক খেতে যেমন মজবুত, নিজেদের সমশ্রেণীর প্রতি অন্যায় অত্যাচার করতে তারা তেমনি প্ৰস্তুত । এই তো হল ওদের দশা- বর্তমানে যাদের হাতে ওদের ভাগ্য ইংরেজের মতো তারা ঐশ্বৰ্যশালী নয়, কেবলমাত্র ১৯১৭ খৃস্টাব্দের পর থেকে নিজের দেশে তাদের অধিকার আরম্ভ হয়েছে ; রাষ্ট্রব্যবস্থা আটে-ঘাটে পাকা হবার মতো সময় এবং সম্বল তারা পায় নি ; ঘরে-বাইরে প্রতিকূলতা ; তাদের মধ্যে আত্মবিদ্রোহ সমর্থন করবার জন্যে ইংরেজ এমন-কি, আমেরিকানরাও গোপনে ও প্ৰকাশ্যে চেষ্টা করছে । জনসাধারণকে, সক্ষম ও শিক্ষিত করে তোলবার জন্যে দশারা যে পণ করেছে। তার “ডিফিকালটি ভারতকর্তৃপক্ষের ডিফিকালটির চেয়ে বহুগুণে বড়ো । অতএব রাশিয়ায় গিয়ে বেশি কিছু দেখতে পাব এরকম আশা করা অন্যায় হত । কীই বা জানি, কীই বা দেখেছি। যাতে আমাদের আশার জোর বেশি হতে পারে । আমাদের দুঃখী দেশে লালিত অতিদুর্বল আশা নিয়ে রাশিয়ায় গিয়েছিলুম। গিয়ে যা দেখলুম তাতে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। ‘ল অ্যান্ড অর্ডার” কী পরিমাণে রক্ষিত হচ্ছে বা না হচ্ছে তার তদন্ত করবার যথেষ্ট সময় পাই নি— শোনা যায়, যথেষ্ট জবরদস্তি আছে ; বিনা বিচারে দ্রুত পদ্ধতিতে শাস্তি, সেও চলে; আর-সব বিষয়ে স্বাধীনতা আছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের বিধানের বিরুদ্ধে নেই । এটা তো হল চাদের কলঙ্কের দিক, কিন্তু আমার দেখবার প্রধান লক্ষ্য ছিল আলোকের দিক । সে দিকটাতে যে দীপ্তি দেখা গেল সে অতি আশ্চৰ্য- যারা একেবারেই অচল ছিল তারা সচল হয়ে উঠেছে । শোনা যায়। য়ুরোপের কোনো কোনো তীর্থস্থানে দৈবকৃপায় এক মুহুর্তে চিরপঙ্গু তার লাঠি ফেলে । এসেছে। এখানে তাই হল ; দেখতে দেখতে কুঁড়িয়ে চলাবার লাঠি দিয়ে এরা ছুটে চলাবার রথ বানিয়ে নিচ্ছে, পদাতিকের অধম যারা ছিল তারা বছর দশেকের মধ্যে হয়ে উঠেছে রাখী । মানবসমাজে তারা । মাথা তুলে দাড়িয়েছে, তাদের বুদ্ধি স্বােবশ, তাদের হাত-হাতিয়ার স্ববশ । আমাদের সম্রাট্রবংশীয় খৃস্টান পাদ্রিরা বহুকাল ভারতবর্ষে কাটিয়েছেন, ডিফিকালটিজ যে কিরকম অনড় তা তারা দেখে এসেছেন । একবার তাদের মস্কেী আসা উচিত । কিন্তু এলে বিশেষ ফল হবে না । কারণ বিশেষ করে কলঙ্ক দেখাই তাদের ব্যবসা-গত অভ্যাস ; আলো চোখে পড়ে না, বিশেষত যাদের উপর বিরাগ আছে । ভুলে যান। তাদের শাসনচন্দ্ৰেও কলঙ্ক খুঁজে বের করতে বড়ো চশমার দরকার করে না । প্ৰায় সত্তর বছর আমার বয়স হল ; এতকাল আমার ধৈর্যচ্যুতি হয় নি । নিজেদের দেশের অতি দুৰ্ব্বহ মুঢ়তার বোঝার দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যকেই বেশি করে দোষ দিয়েছি। অতি সামান্য শক্তি নিয়ে অতি সামান্য প্ৰতিকারের চেষ্টাও করেছি, কিন্তু জীৰ্ণ আশার রথ যত মাইল চলেছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় দড়ি ছিড়েছে, চাকা ভেঙেছে । দেশের হতভাগাদের দুঃখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত অভিমান বিসর্জন দিয়েছি। কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্য চেয়েছি ; তারা বাহবাও দিয়েছেন ; বেটুকু ভিক্ষে দিয়েছেন তাতে জাত যায়৷ পেট ভরে না । সব চেয়ে দুঃখ এবং লাজার কথা এই যে, তাদের প্ৰসাদলালিত আমাদের স্বদেশী জীবরাই সব চেয়ে বাধা দিয়েছে। যে দেশ। পরের কর্তৃত্বে চালিত সেই দেশে সব চেয়ে গুরুতর ব্যাধি হল এইঃ- সে-সব জায়গায় দেশের লোকের মনে যে ঈর্ষা যে ক্ষুদ্রতা যে স্বদেশবিরুদ্ধতার কলুব জন্মায় তার মতো বিব নেই।