পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(( 1 Ե՞ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সোভিয়েটরা রুশসম্রাটকৃত অপমান এবং আত্মকৃত অপমানের হাত থেকে এই দেশকে বঁচিয়েছে- অন্য দেশের ধামিকেরা ওদের যত নিন্দাই করুক আমি নিন্দা করতে পারব না । ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো । রাশিয়ার বুকের পরে ধর্ম ও অত্যাচারী রাজার পাথর চাপা ছিল ; দেশের উপর থেকে সেই পাথর নড়ে যাওয়ায় কী প্ৰকাণ্ড নিষ্কৃতি হয়েছে, এখানে এলে সেটা স্বচক্ষে দেখতে পেতে । ইতি ৩ অক্টোবর ১৯৩০ অতলান্তিক মহাসাগর রাশিয়া থেকে ফিরে এসেছি চলেছি আমেরিকার পথে । রাশিয়াযাত্রায় আমার একটিমাত্র উদেশ্য ছিল- ওখানে জনসাধারণের শিক্ষাবিস্তারের কাজ কিরকম চলছে আর ওরা তার ফল কিরকম পাচ্ছে সেইটো অল্প সময়ের মধ্যে দেখে নেওয়া । আমার মত এই যে, ভারতবর্ষের বুকের উপর যতি-কিছু দুঃখ আজ অভ্ৰভেদী হয়ে দাড়িয়ে আছে তার একটিমাত্র ভিত্তি হচ্ছে অশিক্ষা । জাতিভেদ, ধর্মবিরোধ, কর্মজড়তা, আর্থিক দৌর্বল্য- সমস্তই আঁকড়ে আছে। এই শিক্ষার অভাবকে । সাইমন কমিশনে ভারতবর্ষের সমস্ত অপরাধের তালিকা শেষ করে ব্রিটিশ শাসনের কেবল একটিমাত্র অপরাধ কবুল করেছে । সে হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষাবিধানের ক্রটি । কিন্তু আর-কিছু বলবার দরকার ছিল না । মনে করুন। যদি বলা হয়- গৃহস্থ সাবধান হতে শেখে নি ; এক ঘর থেকে আর-এক ঘরে যেতে চৌকাঠে ইচাট লেগে সে আছাড়ি খেয়ে পড়ে ; জিনিসপত্র কেবলই হারায়, তার পরে খুঁজে পায় না ; ছায়া দেখলে তাকে জুজু বলে ভয় করে ; নিজের ভাইকে দেখে চোর এসেছে বলে লাঠি উচিয়ে মারতে যায় ; কেবলই বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকে ; উঠে হেঁটে বেড়াবার সাহসই নেই ; খিদে পায়, কিন্তু খাবার কোথায় আঁছে খুঁজে পায় না ; অদৃষ্ট্রের উপর অন্ধ নির্ভর করে থাকা ছাড়া অন্য সমস্ত পথ তার কাছে লুপ্ত ; অতএব নিজের গহস্থালির তদারকের ভার তার উপর দেওয়া চলে না- তার পরে সবশেষে গলা অত্যন্ত থাটো করে যদি বলা হয় “আমি ওর বাতি নিবিয়ে রেখেছি’- তা হলে সেটা কেমন হয় । ওরা একদিন ডাইনী বলে নিরপরাধকে পুড়িয়েছে, পাপিষ্ঠ বলে বৈজ্ঞানিককে মেরেছে, ধর্মমতের স্বাতন্ত্র্যকে অতি নিষ্ঠুরভাবে পীড়ন করেছে, নিজেরই ধর্মের ভিন্ন সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রাধিকারকে খর্ব করে রেখেছে, এ ছাড়া কত অন্ধতা কত মৃঢ়তা কত কদাচার মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে তার তালিকা তৃপাকার করে তোলা যায় । এ-সমস্ত দূর হল কী করে । বাইরেকার কোনো কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের হাতে ওদের অক্ষমতার সংস্কারসাধনের ভার দেওয়া হয় নি ; একটিমাত্র শক্তি ওদের এগিয়ে দিয়েছে, সে হচ্ছে ওদের শিক্ষা । জাপান এই শিক্ষার যোগেই অল্পকালের মধ্যেই দেশের রাষ্ট্রশক্তিকে সর্বসাধারণের ইচ্ছা ও চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে, দেশের অর্থ-উৎপাদনের শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে । বর্তমান তুরস্ক প্রবলবেগে এই শিক্ষা অগ্রসর করে দিয়ে ধর্মািন্ধতার প্রবল বোঝা থেকে দেশকে মুক্ত করবার পথে চলেছে। “ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়” । কেননা ঘরে আলো আসতে দেওয়া হয় নি ; যে আলোতে আজকের পৃথিবী জেগে সেই শিক্ষার আলো ভারতের রুদ্ধ দ্বারের বাইরে । রাশিয়ায় যখন যাত্রা করলুম খুব বেশি আশা করি নি । কেননা, কতটা সাধ্য এবং অসাধ্য তার আদর্শ ব্রিটিশ ভারতবর্ষ থেকেই আমি পেয়েছি। ভারতের উন্নতিসাধনের দুরূহতা যে কত বেশি সে কথা স্বয়ং খৃস্টান পাদ্রি টমসন অতি করুণস্বরে সমস্ত পৃথিবীর কাছে জানিয়েছে । আমাকেও মানতে হয়েছে দুরূহতা আছে বৈকি, নইলে আমাদের এমন দশা হবেই বা কেন । একটা কথা আমার জানা