পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম ఆరిచి মানুষকে অবমানিত ও পরস্পরিব্যবহারে আতঙ্কিত করে রাখে । আমাদের দেশে এই দুর্যোগ আমাদের শক্তি ও সৌভাগ্যের মূলে আঘাত করছে। অন্য দেশেও তার দৃষ্টান্ত আছে । সাম্প্রদায়িক খৃস্টান ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক দেবচরিত্রে। পূজাবিধিতে চরিত্রবিকৃতি বা হিংস্রতা দেখে অবজ্ঞা প্ৰকাশ করেন । সংস্কারবশত দেখতে পান না, মানুষের আপনি অহিতবুদ্ধি তাদেরও দেবতার ধারণাকে কিরকম নিদারুণভাবে অধিকার করতে পারে । অঙ্গসুদীক্ষা বা ব্যাপটিজম হবার পূর্বে কোনো শিশুর মৃত্যু হলে যে সাম্প্রদায়িক শাস্ত্ৰমতে তার অনন্ত নরকবাস বিহিত হতে পারে সেই শাস্ত্ৰমতে দেবচরিত্রে যে অপরিসীম নির্দয়তার আরোপ করা হয় তার তুলনা কোথায় আছে। বস্তুত, যে-কোনো পাপের প্রসঙ্গেই হােক, অনন্ত-নিরকের কল্পনা হিংস্রবৃদ্ধির চরম প্ৰকাশ । যুরোপে মধ্যযুগে শাস্ত্রগত ধর্মবিশ্বাসকে অবিচলিত রাখার জন্যে যে বিজ্ঞানবিদ্বেষী ও ধর্মবিরুদ্ধ উৎপীড়ন আচরিত তার ভিত্তি এইখানে । সেই নরকের আদর্শ সভ্যমানুষের জেলখানায় আজও বিভীষিকা বিস্তার করে আছে । সেখানে শোধন করবার নীতি নেই, আছে শাসন করবার হিংস্ৰতা । মনুষ্যত্বের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেবতার উপলব্ধি মোহমুক্ত হতে থাকে, অন্তত হওয়া উচিত । হয় না যে তার কারণ, ধৰ্মসম্বন্ধীয় সব-কিছুকেই আমরা নিত্য বলে ধরে নিয়েছি । ভুলে যাই যে, ধর্মের নিত্য আদর্শকে শ্রদ্ধা করি বলেই ধর্মমতকেও নিত্য বলে স্বীকার করতে হবে এমন কথা বলা চলে না । ভৌতিক বিজ্ঞানের মূলে নিত্য সত্য আছে বলেই বৈজ্ঞানিক মতিমাত্রই নিত্য, এমন গোড়ামির কথা যদি বলি তা হলে আজও বলতে হবে, সূৰ্যই পৃথিবীকে প্ৰদক্ষিণ করছে। ধর্ম সম্বন্ধে সাধারণত এই ভুলই ঘটে ; সম্প্রদায় আপন মতকেই বলে ধর্ম, আর ধর্মকেই করে আঘাত । তার পরে যে বিবাদ, যে নির্দয়তা, যে বুদ্ধিবিচারহীন অন্ধসংস্কারের প্রবর্তন হয় মানুষের জীবনে আর-কোনো বিভাগে তার তুলনাই পাওয়া যায় না । এ কথা মানতে হবে, ভুল মত মানুষেরই আছে, জন্তুর নেই। আদিম কাল থেকে আজ পর্যন্ত ভুল মতবাদের উদ্ভব হচ্ছে, যেহেতু মানুষের একটা দুনিবার সমগ্রতার বোধ আছে। কোনো-একটা তথ্য যখন স্বতন্ত্রভাবে বিচ্ছিন্নভাবে তার সামনে আসে তখন তাকেই সম্যক বলে সে স্বীকার করে নিতে পারে না । তাকে পূৰ্ণ করবার আগ্রহে কল্পনার আশ্রয় নেয় । সেই কল্পনা প্রকৃতিভেদে মূঢ় বা প্রাজ্ঞ, সুন্দর বা কুৎসিত, নিষ্ঠুর বা সকরুণ, নানাপ্রকার হতে পারে । কিন্তু, মূল কথাটা হচ্ছে, তার এই বিশ্বাস যে, প্ৰত্যক্ষ বিচ্ছিন্নতাকে পরিপূর্ণ করে আছে অপ্ৰত্যক্ষ নিখিলতার সত্য । সমগ্রকে উপলব্ধি করবার যে প্রেরণা আছে তার মনে সেই তার ভূমার বোধ । মানুষ অন্তরে বাহিরে অনুভব করে, সে আছে একটি নিখিলের মধ্যে । সেই নিখিলের সঙ্গে সচেতন সচেষ্ট যোগসাধনের দ্বারাই সে আপনাকে সত্য করে জানতে থাকে। বাহিরের যোগে তার সমবৃদ্ধি ভিতরের যোগে তার সার্থকতা । - আমাদের ভৌতিক দেহ স্বতন্ত্র পদার্থ নয় । পৃথিবীর মাটি জল বাতাস উত্তাপ, পৃথিবীর ওজন আয়তন গতি, সমস্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যে এই শরীর ; কোথাও তার সঙ্গে এর একান্ত ছেদ নেই । বলা যেতে পারে, পৃথিবী মানুষের পরম দেহ ; সাধনার দ্বারা যোগবিস্তারের দ্বারা এই বিরাটকে মানুষ আপন করে তুলছে, বড়ো দেহের মধ্যে ছোটাে দেহকে প্রসারিত করছে, বিশ্বভৌতিক শক্তিকে আয়ত্ত করে। পরিমিত দেহের কর্মশক্তিকে পরিপূর্ণ করছে, চোখ স্পষ্টতর করে দেখছে সুদূরস্থ মহীয়ান ও নিকটস্থ কনীয়ানকে, দুই হাত পাচ্ছে বহুসহস্ৰ হাতের শক্তি, দেশের দূরত্ব সংকীর্ণ হয়ে আমাদের দেহের । নিকটবতী হচ্ছে। একদিন সমস্ত ভৌতিক শক্তি দেহশক্তির পরিশিষ্ট হয়ে উঠবে, মানুষের এই সংকল্প । সর্বতঃ পাণিপদান্তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম সর্বতঃ শ্রীতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি । এই-বাণীকে নিজের মধ্যে সার্থক করবে— সেই স্পর্ধা নিয়ে মানুষ অগ্রসর । একেবারে নতুন-কিছু