পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WV\SObr T রবীন্দ্র-রচনাবলী উদ্ভাবন করবে তা নয়, নিজের দেহশক্তির সঙ্গে বিরাট ভৌতিক শক্তির সংযোগকে উত্তরতর করে তুলবে । মনে করা যাক, সবই হল, ভৌতিক শক্তির পূর্ণতাই ঘটল । তবু কি মানুষ বলতে ছাড়বে “ততঃ কিম । রামায়ণে বর্ণিত দশাননের শরীরে মানবের স্বভাবসিদ্ধ দেহশক্তি বহুগুণিত হয়েছিল, দশ দিক থেকে আহরিত ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়েছিল স্বৰ্ণলঙ্কাপুরী । কিন্তু মহাকাব্যে শেষ জায়গাটা সে পেল না । তার পরাভব হল রামচন্দ্রের কাছে । অর্থাৎ, বাহিরে যে দরিদ্র, আত্মায় যে ঐশ্বর্যবান, তার কাছে । সংসারে এই পরাভব আমরা যে সর্বদা প্ৰত্যক্ষ করে থাকি তা নয়, অনেক সময়ে তার বিপরীত দেখি ; তবু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মানুষ একে পরাভব বলে । মানুষের আর-একটা গৃঢ় জগৎ আছে, সেইখানেই এই পরাভরের অর্থ পাওয়া যায়। সেই হল তার আত্মার জগৎ । আপনি সত্তার পরিচয়ে মানুষের ভাষায় দুটি নাম আছে । একটি অহং, আর-একটি আত্মা । প্ৰদীপের সঙ্গে একটিকে তুলনা করা যায়, আর-একটিকে শিখার সঙ্গে । প্ৰদীপ আপনার তেল সংগ্রহ করে । আপনার উপাদান নিয়ে প্ৰদীপের বাজার দর, কোনোটার দর সোনার, কোনোটার মাটির । শিখা আপনাকেই প্ৰকাশ করে, এবং তারই প্ৰকাশে আর-সমস্তও প্ৰকাশিত । প্ৰদীপের সীমাকে উত্তীৰ্ণ হয়ে সে প্ৰবেশ করে নিখিলের মধ্যে । মানুষের আলো জ্বালায় তার আত্মা, তখন ছোটাে হয়ে যায় তার সঞ্চায়ের অহংকার । জ্ঞানে প্রেমে ভাবে বিশ্বের মধ্যে ব্যাপ্তি-দ্বারাই সার্থক হয়। সেই আত্মা । সেই যোগের বাধাতেই তার অপকর্ষ । জ্ঞানের যোগে বিকার ঘটায় মোহ, ভাবের যোগে অহংকার, কর্মের যোগে লোভ স্বার্থপরতা । ভৌতিক বিশ্বে সত্য আপনি সর্বব্যাপক ঐক্য প্রমাণ করে, সেই ঐক্য-উপলব্ধিতে আনন্দিত হয়। বৈজ্ঞানিক । তেমনি আত্মার আনন্দ আত্মিক ঐক্যকে উপলব্ধি-দ্বারা ; যে আত্মার সম্বন্ধে উপনিষদ বলছেন তমেবৈকং জানাথ আত্মানম— সেই আত্মাকে জানো, সেই এককে, যাকে সকল আত্মার মধ্যে এক করে জানলে সত্যকে জানা হয় । প্রার্থনােমন্ত্রে আছে যা একঃ, যিনি এক, স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনতু শুভবুদ্ধির দ্বারা তিনি আমাদের সকলকে এক করে দিন । যে বুদ্ধিতে আমরা সকলে মিলি সেই বুদ্ধিই শুভবুদ্ধি, সেই বুদ্ধিই আত্মার । যথৈবাত্মা পরস্তদবদ দ্রষ্টব্যঃ শুভমিচ্ছতা । আপনার মতো করে পরকে দেখার ইচ্ছাকেই বলে শুভ-ইচ্ছা, সিদ্ধিলোভেও শুভ নয়, পুণ্যলোভেও শুভ নয় । পরের মধ্যে আপন চৈতন্যের প্রসারণেই শুভ, কেননা পরম মানবাত্মার মধ্যেই আত্মা সত্য । সর্বব্যাপী স ভগবান তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ— যেহেতু ভগবান সর্বগত, সকলকে নিয়ে আছেন, সেইজন্যেই তিনি শিব । সমগ্রের মধ্যেই শিব, শিব ঐক্যবন্ধনে । আচারীরা সামাজিক কৃত্রিম বিধির দ্বারা যখন খণ্ডতার সৃষ্টি করে তখন কল্যাণকে হারায়, তার পরিবর্তে যে কাল্পনিক পদার্থ দিয়ে আপনাকে ভোলায় তার নাম দিয়েছে পুণ্য । সেই পুণ্য আর যাই হােক সে শিব নয় । সেই সমাজবিধি আত্মার ধর্মকে পীড়িত করে । স্বলক্ষণস্তু যো বেদ স মুনিঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে | আত্মার লক্ষণকে যে জানে সেই মুনি, সেই শ্রেষ্ঠ । আত্মার লক্ষণ হচ্ছে শুভবুদ্ধি, যে শুভবুদ্ধিতে সকলকে এক করে । পৃথিবী আপনাতে আপনি আবর্তিত, আবার বৃহৎ কক্ষপথে সে সূর্যকে প্ৰদক্ষিণ করছে। মানুষের সমাজেও যা-কিছু চলছে সেও এই দুইরকমের বেগে । এক দিকে ব্যক্তিগত আমি’র টানে ধনসম্পদপ্রভুত্বের আয়োজন পুঞ্জিত হয়ে উঠছে, আর-এক দিকে অমিতমানবের প্রেরণায় পরস্পরের সঙ্গে তার কর্মের যোগ, তার আনন্দের যোগ, পরস্পরের উদ্দেশে ত্যাগ। এইখানে আত্মার লক্ষণকে স্বীকার করার দ্বারাই তার শ্রেষ্ঠতার উপলব্ধি । উভয়ের মধ্যে পাশাপাশি কিরকম বিপরীত অসংগতি দেখা যায় একটা তার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক । কয়েক বৎসর পূর্বে লন্ডনের টাইমস পত্রে একটি সংবাদ বেরিয়েছিল, আমেরিকার নেশন পত্ৰ থেকে তার বিবরণ পেয়েছি। বায়ুপোতে চড়ে ব্রিটিশ বায়ুনাবিকসৈন্য আফগানিস্থানে মাহসুদ গ্রাম ধবংস করতে লেগেছিল ; শতয়ীবার্ষিণী একটা বায়ুতরী বিকল হয়ে গ্রামের মাঝখানে গেল পড়ে । একজন আফগান মেয়ে নাবিকদের নিয়ে গেল নিকটবতী গুহার মধ্যে, একজন মালিক তাদের রক্ষার