পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৯২ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিবার কোনো আশাও দেখি না। কেবল ইংরেজকে অনুরোধ করিতেছি, তিনি যে-শাখায় দাড়াইয়া আছেন, সেই শাখাটাকে অনুগ্রহপূর্বক ছেদন করিতে থাকুন। সেই অনুরোধ ইংরেজ যেদিন পালন করিবে, সেদিনের জন্য অপেক্ষা করিতে হইলে কালবিলম্ব হইবার আশঙ্কা আছে । যেখানে আমাদের অধিকার নাই, সেখানে কখনো কপট করজোড়ে কখনো কপট সিংহনাদে ধাবমান হওয়া বিড়ম্বনা, সে-কথা আমরা ক্রমেই অনুভব করিতেছি । বুঝিতেছি, নিজের চেষ্টার দ্বারা নিজের ক্ষমতা-অনুযায়ী স্থায়ী যাহা-কিছু করিয়া তুলিতে পারিব, তাহাতেই আমাদের নিস্তার। যে-জিনিসটা এ বৎসর একজন কৃপা করিয়া দিবে, পাচ বৎসর বাদে আর-একজন গালে চড় মারিয়া কাড়িয়া লইবে, সেটা যতবড়ো জিনিস হোক, আমাদিগকে এক ইঞ্চিও বড়ো করিতে পারিবে না। কোনো বিষয়ে একটা-কিছু করিয়া তুলিতে যদি চাই তবে উজান স্রোতে সাতার দিয়া তাহ পারিব না । কোথায় আমাদের বল, আমাদের প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি কোনদিকে, তাহ বাহির করিতে হইবে । তাহ বাহির করিতে হইলেই নিজেকে যথার্থরূপে চিনিয়া লইতে হইবে । হতাশ ব্যক্তিরা বলেন, চিনিব কেমন করিয়া । বিদেশী শিক্ষায় আমাদের চোখে ধুলা দিতেছে। ধুলা নহে, তাহ অঞ্চন। বিপরীত সংঘাত ব্যতীত মহত্বশিখা জলিয়া উঠে না। খৃষ্টধর্ম যুরোপীয় প্রকৃতির বিপরীত শক্তি। সেই শক্তির দ্বারা মথিত হইয়াই যুরোপীয় প্রকৃতির সারভাগ এমন করিয়া দানা বাধিয়া উঠিয়াছে। 臀 তেমনই যুরোপীয় শিক্ষা ভারতবর্ষীয় প্রকৃতির পক্ষে বিপরীত শক্তি। এই শক্তির দ্বারাই আপনাকে যথার্থরূপে উপলব্ধি করিব এবং ফুটাইয়া তুলিব । আমাদের শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে সেই লক্ষণ দেখা গিয়াছে । অন্তত নিজেকে আদ্যোপাস্তভাবে জানিবার জন্ত আমাদের একটা ব্যাকুলতা জন্মিয়াছে। প্রথম আবেগে অনেকটা হাতড়াইতে হয়, উদ্যমের অনেকটা বাজেখরচ হইয়া যায়। এখনও আমাদের সেই হাস্যকর অবস্থাটা কাটিয়া যায় নাই । কিন্তু কাটিয়া যাইবে । পূর্বপশ্চিমের আলোড়ন হইতে আমরা কেবলই যে বিষ পাইব, তাহা নহে ; যে-লক্ষ্মী ভারতবর্ষের হৃদয়সমুদ্রতলে অদৃপ্ত হইয়া আছেন তিনি একদিন অপূৰ্বজ্যোতিতে বিশ্বভুবনের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে দৃশুমান হইয়া উঠিবেন। নতুবা, যে ভারতে আর্যসভ্যতার সর্বপ্রথম উন্মেষ দেখা দিয়াছিল, সেই ভারতেই সুদীর্ঘকাল পরে আর্যসভ্যতার বর্তমান উত্তরাধিকারিগণ কী করিতে আসিয়াছে।