পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

tes VS ভালোবাসা অন্ধ, কিন্তু এখানে সেই অন্ধের উপর তো কোনো ভার নেই। সংসারবুদ্ধির দুটাে চোখের চেয়ে আরো বেশি চোখ আছে- সেই চক্ষু যখন বিনা নেশায় আমার দিকে তাকিয়ে দেখে তখন আমার মধ্যে কী দেখতে পায় আমি তাই ভাবি । আমার গুণ নিশ্চয়ই অনেক আছে, কিন্তু সেগুলো তো ধরা পড়তে দেরি লাগে, এক চাহনিতেই বোঝা যায় না । আমার নাসার মধ্যে যে খর্বতা আছে বুদ্ধির উন্নতি তা পূরণ করেছে জানি, কিন্তু নাসাটাই থাকে প্রত্যক্ষ হয়ে, আর ভগবান বুদ্ধিকে নিরাকার করে রেখে দিলেন । যাই হােক, যখন দেখি, কোনো সাবালক মেয়ে অত্যাক্স কালের নোটিশেই আমাকে বিয়ে করতে অত্যন্নমাত্র আপত্তি করে না, তখন মেয়েদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো কমে । আমি যদি মেয়ে হতুম তা হলে শ্ৰীযুৎ সনৎকুমারের নিজের খর্ব নাসার দীর্ঘনিশ্বাসে তার আশা এবং অহংকার ধূলিসাৎ হতে থাকত। এমনি করে আমার বিবাহের বোঝাই-হীন নীেকাটা মাঝে মাঝে চড়ায় ঠেকেছে৷ কিন্তু ঘাটে এসে পৌঁছয় নি । স্ত্রী ছাড়া সংসারের অন্যান্য উপকরণ ব্যাবসার উন্নতির সঙ্গে বেড়ে চলতে লাগল। একটা কথা ভুলে ছিলুম, বয়সও বাড়ছে। হঠাৎ একটা ঘটনায় সে কথা মনে করিয়ে দিলে । অভ্রের খনির তদন্তে ছোটােনাগপুরের এক শহরে গিয়ে দেখি, পণ্ডিতমশায় সেখানে শালবনের ছায়ায় ছোট্ট একটি নদীর ধারে দিব্যি বাসা বেঁধে বসে আছেন । তার ছেলে সেখানে কাজ করে । সেই শালবনের প্রান্তে আমার তাবু পড়েছিল। এখন দেশ জুড়ে আমার ধনের খ্যাতি । পণ্ডিতমশায় বললেন, কালে আমি যে অসামান্য হয়ে উঠব, এ তিনি পূর্বেই জানতেন । তা হবে, কিন্তু আশ্চর্যরকম গোপন করে রেখেছিলেন । তা ছাড়া কোন লক্ষণের দ্বারা জেনেছিলেন আমি তো তা বলতে পারি নে । বোধ করি অসামান্য লোকদের ছাত্র-অবস্থায় ষত্বণত্ব জ্ঞান থাকে না । কাশীশ্বরী শ্বশুরবাড়িতে ছিল, তাই বিনা বাধায় আমি পণ্ডিতমশায়ের ঘরের লোক হয়ে উঠলুম। কয়েক বৎসর পূর্বে তার স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে- কিন্তু তিনি নাতনিতে পরিবৃত। সবগুলি তার স্বকীয়া নয়, তার মধ্যে দুটি ছিল র্তার পরলোকগত দাদার । বৃদ্ধ এদের নিয়ে আপনার বার্ধক্যের অপরাহুকে নানা রঙে রঙিন করে তুলেছেন । তার অমরুশতক আৰ্যসপ্তশতী হংসদূত পদাঙ্কদূতের শ্লোকের ধারা নুড়িগুলির চার দিকে গিরিনদীর ফেনোচ্ছিল প্রবাহের মতো এই মেয়েগুলিকে ঘিরে ঘিরে সহস্যে ধ্বনিত হয়ে উঠছে । আমি হেসে বললুম, “পণ্ডিতমশায়, ব্যাপারখানা কী !” তিনি বললেন, “বাবা, তােমাদের ইংরাজি শাস্ত্রে বলে যে, শনিগ্ৰহ চাঁদের মালা পরে থাকেন— এই আমার সেই চাদের মালা ।” সেই দরিদ্র ঘরের এই দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, আমি একা । বুঝতে পারলুম, আমি নিজের ভারে নিজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । পণ্ডিতমশায় জানেন না যে তার বয়স হয়েছে, কিন্তু আমার যে হয়েছে সে আমি স্পষ্ট জানলুম। বয়স হয়েছে বলতে এইটে বোঝায়, নিজের চারি দিককে ছাড়িয়ে এসেছি— চার পাশে টিলে হয়ে ফাক হয়ে গেছে। সে ফাক টাকা দিয়ে, খ্যাতি দিয়ে, বোজানো যায় না । পৃথিবী থেকে রস পাচ্ছি নে কেবল বস্তু সংগ্ৰহ করছি, এর ব্যর্থতা অভ্যাসবশত ভুলে থাকা যায় । কিন্তু, পণ্ডিতমশায়ের ঘর যখন দেখলুম। তখন বুঝলুম, আমার দিন শুষ্ক, আমার রাত্রি শূন্য। পণ্ডিতমশায় নিশ্চয় ঠিক করে বসে আছেন যে, আমি তার চেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ- এই কথা মনে করে আমার হাসি এল। এই বস্তুজগৎকে ঘিরে একটি অদৃশ্য আনন্দলোক আছে। সেই আনন্দলোকের সঙ্গে আমাদের জীবনের যোগসূত্র না থাকলে আমরা ত্ৰিশঙ্কুর মতো শূন্যে থাকি । পণ্ডিতমশায়ের সেই যোগ আছে, আমার নেই, এই তফাত । আমি আরাম-কেদারার দুই হাতায় দুই পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেতে খেতে ভাবতে লাগলুম পুরুষের জীবনের চার আশ্রমের চার অধিদেবতা । বাল্যে মা ; যৌবনে স্ত্রী ; প্রৌঢ়ে কন্যা, পুত্রবধু ; বার্ধক্যে নাতনি, নাতবাউ । এমনি করে মেয়েদের মধ্য দিয়ে পুরুষ আপনার পূর্ণতা পায় । এই তত্ত্বটা মর্মরিত শালবনে আমাকে আবিষ্ট করে ধরল। মনের সামনে আমার ভাবী বৃদ্ধ বয়সের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত তাকিয়ে দেখলুম- দেখে তার নিরতিশয় নীরসন্তায় হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল। ঐ মরুপথের মধ্য দিয়ে মুনফার বোঝা ঘাড়ে করে নিয়ে কোথায় গিয়ে