পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

see vood বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, আমাদের মধ্যে খুব একজন সম্পত্তি ও প্রতিপত্তিশালী লোক খবরের কাগজ পড়ছিলেন- তিনি তার চশমার উপর থেকে আমার প্রতি দৃষ্টি হেনে বলে উঠলেন, “হিয়ার হিয়ার ” যাক গে। শোনা গেল, নন্দকৃষ্ণের বিধবা শ্ৰী তার একটি মেয়েকে নিয়ে এই পাড়াতেই থাকেন। দেয়ালির রাত্রে মেয়েটির জন্ম হয়েছিল বলে বাপ তার নাম দিয়েছিলেন দীপালি । বিধবা কোনো সমাজে স্থান পান না বলে সম্পূর্ণ একলা থেকে এই মেয়েটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন। এখন মেয়েটির বয়স পঁচিশের উপর হবে । মায়ের শরীর রুগণ এবং বয়সও কম নয়- কোনদিন তিনি মারা যাবেন, তখন এই মেয়েটির কোথাও কোনো গতি হবে না । বিশ্বাপতি আমাকে বিশেষ অনুনয় করে বললেন, “যদি এর পাত্ৰ জুটিয়ে দিতে পারেন তো সেটা একটা পুণ্যকর্ম হবে।” আমি বিশ্বাপতিকে শুকনো স্বার্থপর নিরেট কাজের লোক বলে মনে মনে একটু অবজ্ঞা করেছিলুম। বিধবার অনাথা মেয়েটির জন্য তার এই আগ্ৰহ দেখে আমার মন গলে গেল। ভাবলুম, প্রাচীন পৃথিবীর মৃত ম্যামথের পাকযন্ত্রের মধ্যে থেকে খাদ্যবীজ বের করে পুঁতে দেখা গেছে, তার থেকে অন্ধুর বেরিয়েছে- তেমনি মানুষের মনুষ্যত্ব বিপুল মৃতন্তুপের মধ্যে থেকেও সম্পূর্ণ মরতে চায় না। আমি বিশ্বাপতিকে বললুম, “পাত্র আমার জানা আছে, কোনো বাধা হবে না। আপনারা কথা এবং प्रिन ळेिक कष्क्रन् ।।” “কিন্তু মেয়ে না দেখেই তো আর-” “না দেখেই হবে ।” “কিন্তু, পাত্র যদি সম্পত্তির লোভ করে সে বড়ো বেশি নেই। মা মরে গেলে কেবল ঐ বাড়িখানি পাবে, আর সামান্য যদি কিছু পায় ।” “পাত্রের নিজের সম্পত্তি আছে, সেজন্যে ভাবতে হবে না ।” “র্তার নাম বিবরণ প্রভৃতি-” “সে এখন বলব না, তা হলে জানাজানি হয়ে বিবাহ ফেসে যেতে পারে ।” “মেয়ের মাকে তো তার একটা বৰ্ণনা দিতে হবে ।” “বলবেন, লোকটা অন্য সাধারণ মানুষের মতো দোষে গুণে জড়িত । দোষ এত বেশি নেই যে ভাবনা হতে পারে ; গুণও এত বেশি নেই যে লোভ করা চলে। আমি যতদূর জানি তাতে কন্যার পিতামাতার তাকে বিশেষ পছন্দ করে, স্বয়ং কন্যাদের মনের কথা ঠিক জানা যায় নি ।” বিশ্বপতিবাবু এই ব্যাপারে যখন অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হলেন তখন তার উপরে আমার ভক্তি বেড়ে গেল । যে-কারবারে ইতিপূর্বে তার সঙ্গে আমার দরে বনছিল না, সেটাতে লোকসান দিয়েও রেজিস্ত্রী দলিল সই করবার জন্যে আমার উৎসাহ হল । তিনি যাবার সময় বলে গেলেন, “পাত্রটিকে বলবেন, অন্য সব বিষয়ে যাই হােক, এমন গুণবতী মেয়ে কোথাও পাবেন না ।” যে-মেয়ে সমাজের আশ্রয় থেকে এবং শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত তাকে যদি হৃদয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা যায় তা হলে সে মেয়ে কি আপনাকে উৎসর্গ করতে কিছুমাত্ৰ কৃপণতা করবে। যে মেয়ের বড়ো রকমের আশা আছে তারই আশার অন্ত থাকে না । কিন্তু, এই দীপালির দীপটি মাটির, তাই আমার মতো মেটে ঘরের কোণে তার শিখাটির অমর্যাদা হবে না । সন্ধ্যার সময় আলো জেলে বিলিতি কাগজ পড়ছি, এমন সময় খবর এল, একটি মেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। বাড়িতে স্ত্রীলোক কেউ নেই, তাই ব্যস্ত হয়ে পড়লুম। কোনো ভদ্র উপায় উদ্ভাবনের পূর্বেই মেয়েটি ঘরের মধ্যে ঢুকে প্ৰণাম করলে । বাইরে থেকে কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমি অত্যন্ত লাজুক মানুষ। আমি না তার মুখের দিকে চাইলুম, না তাকে কোনো কথা বললুম। সে বললে, “আমার নাম দীপালি ।” গলাটি ভারি মিষ্টি । সাহস করে মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম, সে মুখ বুদ্ধিতে কোমলতাতে মাখানো । মাথায় ঘোমটা নেই- সাদা দিশি কাপড়, এখনকার ফ্যাশানে পরা । কী বলি ভাবছি, এমন