পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܓܦܠ পুরুষ তার আপনি জগতে বারে বারে নূতন আগন্তুক । আজ পর্যন্ত কতবার সে গড়ে তুলেছে আপন বিধিবিধান । বিধাতা তাকে তার জীবনের পথ বাধিয়ে দেন নি ; কত দেশে। কত কালে তাকে আপন পথ বানিয়ে নিতে হল । এক কালের পথ বিপথ হয়ে উঠল আর-এক কালে, উলটিয়ে গেল তার ইতিহাস, করলে সে অন্তর্ধান । নব নব সভ্যতার উলট-পালটের ভিতর দিয়ে নারীর জীবনের মূলধারা চলেছে এক প্রশস্ত পথে । প্রকৃতি তাকে যে হৃদয়সম্পদ দিয়েছেন নিত্যকৌতুহলপ্রবণ বুদ্ধির হাতে তাকে নূতন নূতন অধ্যবসায়ে পরখ করতে দেওয়া হয় নি। নারী পুরাতনী । পুরুষকে নানা দ্বারে নানা আপিসে উমেদারিতে ঘোরায় । অধিকাংশ পুরুষই জীবিকার জন্যে এমন কােজ মানতে বাধ্য৷হয় যার প্রতি তার ইচ্ছার তার ক্ষমতার সহজ সম্মতি নেই। কঠিন পরিশ্রমে নানা কাজের শিক্ষা তার করা চাই— তাতে বারো-আনা পুরুষই যথোচিত সফলতা পায় না । কিন্তু গৃহিণীরূপে জননীরূপে মেয়েদের যে কাজ সে তার আপনি কাজ, সে তার স্বভাবসংগত । নানা বিষ্ম কাটিয়ে অবস্থার প্রতিকূলতাকে বীর্যের দ্বারা নিজের অনুগত করে পুরুষ মহত্ত্ব লাভ করে । সেই অসাধারণ সার্থকতায় উত্তীর্ণ পুরুষের সংখ্যা অল্প । কিন্তু হৃদয়ের রসধারায় আপন সংসারকে শস্যশালা করে তুলেছে এমন মেয়েকে প্রায় দেখা যায় ঘরে ঘরে । প্রকৃতির কাছ থেকে তারা পেয়েছে অশিক্ষিতাপটুত্ব, মাধুর্যের ঐশ্বর্য তাদের সহজে লাভ করা । যে মেয়ের স্বভাবের মধ্যে দুৰ্ভাগ্যক্রমে সেই সহজ রসটি না থাকে, কোনো শিক্ষায়, কোনো কৃত্রিম উপায়ে সংসারক্ষেত্রে সে সার্থকতা পায় না । যে সম্বল অনায়াসে পাওয়া যায়। তার বিপদ আছে । বিপদের এক কারণ অন্যের পক্ষে তা লোভনীয় । সহজ-ঐশ্বৰ্যবান দেশকে বলবান নিজের একান্ত প্ৰয়োজনে আত্মসাৎ করে রাখতে চায় । অনুর্বর দেশের পক্ষে স্বাধীন থাকা সহজ । যে পাখির ডানা সুন্দর ও কণ্ঠস্বর মধুর তাকে খাচায় বন্দী করে মানুষ গর্ব অনুভব করে ; তার সৌন্দর্য সমস্ত অরণ্যভূমির, এ কথা সম্পত্তিলোলুপীরা ভুলে যায়। মেয়েদের হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণ্যকে পুরুষ সুদীর্ঘকাল আপনি ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে কড়া পাহারায় বেড়া দিয়ে রেখেছে । মেয়েদের নিজের স্বভাবেই বঁাধন-মানা প্রবণতা আছে, সেইজন্যে এটা সর্বত্রই এত সহজ হয়েছে । বস্তুত জীবপালনের কাজটাই ব্যক্তিগত। সেটা নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বের কোঠায় পড়ে না, সেই কারণে তার আনন্দ বৃহৎ তত্ত্বের আনন্দ নয় ; এমন-কি, মেয়েদের নৈপুণ্য যদিও বহন করেছে রস, কিন্তু সৃষ্টির কাজে আজও যথেষ্ট সার্থক হয় নি । তার বুদ্ধি, তার সংস্কার, তার আচরণ নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার দ্বারা বহু যুগ থেকে প্রভাবান্বিত । তার শিক্ষা, তার বিশ্বাস বাহিরের বৃহৎ অভিজ্ঞতার মধ্যে সত্যতা লাভ করবার সম্পূর্ণ সুযোগ পায় নি । এইজন্যে নির্বিচারে সকল অপদেবতাকেই সে অমূলক ভয় ও অযোগ্য ভক্তির অর্ঘ্য দিয়ে আসছে। সমস্ত দেশ জুড়ে যদি দেখতে পাই তবে দেখা যাবে এই মোহমুগ্ধতার ক্ষতি কত সর্বনেশে, এর বিপুল ভার বহন করে উন্নতির দুৰ্গম পথে এগিয়ে চলা কত দুঃসাধ্য। আবিলবুদ্ধি মূঢ়মতি পুরুষ দেশে যে কম আছে তা নয়, তারা শিশুকাল থেকে মেয়ের হাতে গড়া এবং তারাই মেয়েদের প্রতি সব চেয়ে অত্যাচারী । দেশে এই যে-সব আবিল মনের কেন্দ্রগুলি দেখতে দেখতে চারি দিকে গড়ে উঠেছে, মেয়েদের অন্ধ বিচারবুদ্ধির উপরেই তাদের প্রধান নির্ভর । চিত্তের বন্দীশালা এমনি করে দেশে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ছে, এবং প্রতিদিন তার ভিত্তি হয়ে উঠছে দৃঢ় । এ দিকে প্ৰায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এসিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই । তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা-ভাঙার যুগ এসে পড়েছে। যে-সকল দেশ আপনি আপন ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রিক প্রাচীরের মধ্যে একান্ত বদ্ধ ছিল তাদের সেই বেড়া আজ আর তাদের তেমন করে ঘিরে রাখতে পারে না- তারা পরম্পর পরস্পরের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। স্বতই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়েছে, দৃষ্টিসীমা চিরাভ্যস্ত দিগন্ত পেরিয়ে