পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৮ রবীন্দ্র-রচনাবলী র্তাহার হিসাব এক-এক পা করিয়া হঠিতে লাগিল। তাহার পায়ের মল, হাতের বালা, গলার হার, মাথার টুপি, তাহার দিশি বিলাতি নানা রকমের নানা রঙের সাজসজ্জা সম্বন্ধে ননীবালা যাহা-কিছু দাবি উত্থাপিত করিলেন, সব কটাই তিনি কখনো নীরব অশ্রুপাতে, কখনো সরব বাক্যবর্ষণে জিতিয়া লইলেন। বেণুগোপালের জন্য যাহা দরকার এবং যাহা দরকার নয় তাহ চাইই চাই– সেখানে শূন্ত তহবিলের ওজর বা ভবিষ্যতের ফাক আশ্বাস একদিনও খাটিল না । & বেণুগোপাল বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। বেণুর জন্য খরচ করাটা অধরলালের অভ্যাস হইয়া আসিল । তাহার জন্য বেশি মাহিনী দিয়া অনেক-পাস-করা এক বুড়ে মাস্টার রাখিলেন। এই মাস্টার বেণুকে মিষ্টভাষায় ও শিষ্টাচারে বশ করিবার অনেক চেষ্টা করিলেন— কিন্তু তিনি নাকি বরাবর ছাত্রদিগকে কড়া শাসনে চালাইয়া আজ পর্যন্ত মাস্টারি মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া আসিয়াছেন, সেইজন্য র্তাহার ভাষার মিষ্টতা ও আচারের শিষ্টতায় কেবলই বেস্থর লাগিল— সেই শুষ্ক সাধনায় ছেলে তুলিল না । ননীবালা অধরলালকে কহিলেন, “ও তোমার কেমন মাস্টার। ওকে দেখিলেই যে ছেলে অস্থির হইয়া উঠে । ওকে ছাড়াইয়া দাও।” বুড় মাস্টার বিদায় হইল। সেকালে মেয়ে যেমন স্বয়ম্বর হইত তেমনি ননীবালার ছেলে স্বয়ম্মাস্টার হইতে বসিল— সে যাহাকে না বরিয়া লইবে তাহার সকল পাস ও সকল সার্টিফিকেট বৃথা । এমনি সময়টিতে গায়ে একখানি ময়লা চাদর ও পায়ে ছেড়া ক্যাম্বিসের জুত। পরিয়া মাস্টারির উমেদারিতে হরলাল আসিয়া জুটিল। তাহার বিধবা মা পরের বাড়িতে রাধিয়া ও ধান ভানিয়া তাহাকে মফস্বলের এনট্রেন্স স্কুলে কোনোমতে এনট্রেন্স, পাস করাইয়াছে। এখন হরলাল কলিকাতায় কলেজে পড়িবে বলিয়া প্রাণপণ প্রতিজ্ঞ করিয়া বাহির হইয়াছে। অনাহারে তাহার মুখের নিম্ন অংশ শুকাইয়া ভারতবর্ষের কন্যাকুমারীর মতো সরু হইয়া আসিয়াছে, কেবল মস্ত কপালটা হিমালয়ের মতো প্রশস্ত হইয়া অত্যন্ত চোখে পড়িতেছে। মরুভূমির বালু হইতে স্থধের আলো যেমন ঠিকরিয়া পড়ে তেমনি তাহার দুই চক্ষু হইতে দৈন্তের একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি বাহির হইতেছে। দরোয়ান জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কী চাও। কাহাকে চাও।” হরলাল ভয়ে ভয়ে বলিল, “বাড়ির বাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চাই।” দরোয়ান কহিল, “দেখা হইবে না।” তাহার উত্তরে হরলাল কী বলিবে ভাবিয়া না পাইয়া ইতস্তত