পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি 8 S ক্ষণিক উপসর্গ ঘটিয়াছে মনে করিয়া মহেন্দ্ৰ নিশ্চিন্ত আছে; কিন্তু এই আশঙ্কাশূন্য অনুদবেগাই রাজলক্ষ্মীর কাছে বড়ো কঠিন বলিয়া মনে হইল। মহেন্দ্র প্রেমোন্মত্ততায় কোনো আশঙ্কাকে, কোনো কর্তব্যকে মনে স্থান দিতে চায় না, তাই সে মাতার কষ্টকে পীড়াকে এতই লঘু করিয়া দেখিয়াছে— পাছে জননীর রোগশয্যায় তাহাকে আবদ্ধ হইয়া পড়িতে হয়, তাই সে এমন নির্লজের মতো একটু অবকাশ পাইতেই বিনোদিনীর কাছে পলায়ন করিয়াছে। রোগ-আরোগ্যের প্রতি রাজলক্ষ্মীর আর লেশমাত্র উৎসাহ রহিল না— মহেন্দ্রের অনুদবেগ যে অমূলক, দারুণ অভিমানে ইহাই তিনি প্ৰমাণ করিতে চাহিলেন। বেলা দুটার সময় আশা কহিল, “মা, তোমার ওষুধ খাইবার সময় হইয়াছে।” রাজলক্ষ্মী উত্তর না। দিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। আশা ওষুধ আনিবার জন্য উঠিলে তিনি বলিলেন, “ওষুধ দিতে হইবে না বউমা, তুমি যাও।” আশা মাতার অভিমান বুঝিতে পারিল— সে অভিমান সংক্ৰামক হইয়া তাহার হৃদয়ের আন্দোলনে দ্বিগুণ দোলা দিতেই আশা আর থাকিতে পারিল না— কান্না চাপিতে চাপিতে গুমরিয়া কাদিয়া উঠিল। রাজলক্ষ্মী ধীরে ধীরে আশার দিকে পাশ ফিরিয়া তাহার হাতের উপরে সকরুণ স্নেহে আস্তে আস্তে হাত বুলাইতে লাগিলেন, কহিলেন, “বউমা, তোমার বয়স অল্প, এখনো তোমার সুখের মুখ দেখিবার সময় আছে। আমার জন্য তুমি আর চেষ্টা করিয়ো না, বাছা— আমি তো অনেক দিন বাচিয়াছি- আর কী হইবে।” শুনিয়া আশার রোদন আরো উচ্ছসিত হইয়া উঠিল— সে মুখের উপর আঁচল চাপিয়া ধরিল। এইরূপে, রোগীর গৃহে নিরানন্দ দিন মন্দগতিতে কাটিয়া গেল। অভিমানের মধ্যেও এই দুই নারীর ভিতরে ভিতরে আশা ছিল, এখনই মহেন্দ্ৰ আসিবে । শব্দ মাত্ৰেই উভয়ের দেহে যে একটি চমক-সঞ্চার হইতেছিল, তাহা উভয়েই বুঝিতে পারিতেছিলেন। ক্রমে দিব্যাবসানের আলোক সুস্পষ্ট হইয়া আসিল, কলিকাতার অন্তঃপুরের মধ্যে সেই গোধূলির যে আভা, তাহাতে আলোকের প্রফুল্লতাও নাই, অন্ধকারের আবরণও নাই— তাহা বিষাদকে গুরুভার এবং নৈরাশ্যকে অশ্রুইন করিয়া তোলে, তাহা কর্ম ও আশ্বাসের বলা হরণ করে অথচ বিশ্রাম ও বৈরাগ্যের শান্তি আনয়ন করে না। রুগণগহের সেই শুষ্ক শ্ৰীহীন সন্ধ্যায়। আশা নিঃশব্দপদে উঠিয়া একটি প্ৰদীপ জ্বালিয়া ঘরে আনিয়া দিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউমা, আলো ভালো লাগিতেছে না, প্ৰদীপ বাহিরে রাখিয়া দাও।” আশা প্ৰদীপ বাহিরে রাখিয়া আসিয়া বসিল । অন্ধকার যখন ঘনতর হইয়া এই ক্ষুদ্র কক্ষের মধ্যে বাহিরের অনন্ত রাত্ৰিকে আনিয়া দিল, তখন আশা রাজলক্ষ্মীকে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “মা, তাহাকে কি একবার খবর দিব।” রাজলক্ষ্মী দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “না বউমা, তোমার প্রতি আমার শপথ রহিল, মহেন্দ্ৰকে খবর দিয়ো না ।” শুনিয়া আশা স্তব্ধ হইয়া রহিল ; তাহার। আর কঁদিবার বল ছিল না। শুনিয়া মুহূর্তের মধ্যে রাজলক্ষ্মীর মনে হইল, মহেন্দ্রের হয়তো হঠাৎ একটা কিছু ব্যামো হইয়াছে, তাই সে কোনোমতেই আসিতে না পারিয়া চিঠি পাঠাইয়াছে। অনুতপ্ত ও ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “দেখো কিছুদিন হইতে সে ভালো বোধ করিতেছিল না, তাই সে পশ্চিমে বেড়াইতে যাইতেছে। মাতার অসুখের জন্য বিশেষ চিন্তার কারণ কিছুই নাই। তাহাকে নিয়মিত দেখিবার জন্য সে নবীন-ডাক্তারকে বলিয়া দিয়াছে। রাত্রে ঘুম না হইলে বা মাথা ধরিলে কখন কী করিতে হইবে তাহাও চিঠির মধ্যে লেখা আছে— এবং দুই টিন লঘু ও পুষ্টিকর। পথ্য মহেন্দ্র ডাক্তারখানা হইতে আনাইয়া চিঠির সঙ্গে পঠাইয়াছে। আপাতত গিরিধির ঠিকানায় মাতার সংবাদ অবশ্য-অবশ্য জানাইবার জন্য পুনশ্চের মধ্যে